ঢাকার উত্তরা থেকে নিখোঁজ হওয়ার দুদিন পর জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রুকুনুজ্জামানকে পাওয়া গেছে ১৭২ কিলোমিটার দূরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে।
গতকাল বুধবার দুপুরে তাঁকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালীঘাট ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে পান দুজন গ্রাম পুলিশ। মেয়রের বরাত দিয়ে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার জানান, তাঁকে একটি কালো মাইক্রোবাসে করে এনে এখানে নামিয়ে দেওয়া হয়। মাইক্রোবাসে তাঁর চোখ বাঁধা ছিল।
গতকাল বিকেলে শ্রীমঙ্গলের কালীঘাট ইউপি কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় গ্রাম পুলিশ অশোক কানু ও ইউনিয়নের দফাদার গৌরলাল ভূমিজের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে মেয়রকে প্রথম দেখেছেন অশোক কানু। তিনি বলেন, ‘তখন সাড়ে ১২টা থেকে ১টা হবে। ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের গেটের সামনে দাঁড়ানো একজনকে দেখতেছি। দেখে ভদ্রলোকই মনে হচ্ছিল। তবে পায়ে জুতা ছিল না। পরনে কালো পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম “কোথায়, কার কাছে যাবেন?” তিনি কিছু বললেন না। একসময় আমার হাত ধরে বললেন, “আমি একজন মেয়র, আমাকে বাঁচান।” আমি হেসে দিয়েছি। কোথাকার মেয়র উনি, এখানে কেন!’
অশোক কানু ও গৌরলাল ভূমিজ জানালেন, তাঁদের ইউনিয়ন কার্যালয়ে পত্রিকা রাখা হয়। গতকালের পত্রিকা প্রথম পাতায় মেয়রের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদটি ছবিসহ প্রকাশিত হয়, সেটি দেখেছেন তাঁরা। মেয়রের ছবির কথা তাঁদের মনে পড়ে যায়। এরপর তাঁরা পত্রিকার ছবির সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে দেখেন। তাঁরা বলেন, লোকটি খুব আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন।
অশোক ও গৌরলাল বলেন, চেহারার মিল পেয়ে তাঁরা রুকুনুজ্জামানকে ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে ইউপি ভবনে সচিবের কক্ষে নিয়ে পাখার নিচে বসান। পানি পান করান। মেয়রের কথামতো তাঁর মাথায় পানিও ঢালেন তাঁরা। এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান সেখানে ছিলেন না। ইউপি সচিব ঘটনাটি চেয়ারম্যান, পুলিশ ও প্রশাসনকে জানান। এরপর শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোবাশশেরুল ইসলাম ও শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম নজরুল সেখানে আসেন। ইউপি চেয়ারম্যান প্রাণেশ গোয়ালাও খবর পেয়ে দ্রুত চলে আসেন। বেলা দেড়টার দিকে উদ্ধার হওয়া মেয়র রুকুনুজ্জামানকে শ্রীমঙ্গল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
কালীঘাট ইউপির সচিব মিন্নাত আলী বলেন, ‘উনি (মেয়র) খুব ভয় পাচ্ছিলেন। অফিসে ঢোকার সময় হাঁটতে পারছিলেন না। বলছিলেন, “ওরা আমাকে মেরে ফেলবে”। আমরা তাঁকে বলি, এখানে আর কোনো সমস্যা হবে না। পত্রিকার সংবাদ ও ছবি দেখালে উনি নিজেই বলেন ‘এটা আমার ছবি।”’
ইউপি সচিব জানান, মেয়রকে একটি কালো মাইক্রোবাস থেকে নামানোর দৃশ্য স্থানীয় একজন নারী দেখেছেন। ওই নারী পরে তাঁকে এ কথা জানান। ওই সময় বেশ কটি গাড়ি ইউপি কার্যালয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল।
কালীঘাট ইউপি চেয়ারম্যান প্রাণেশ গোয়ালা বলেন, ‘ওনার কথাবার্তা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। খুব ভয় পাইছিলেন। বেশি কথাবার্তা বলতে পারছিলেন না। উনি বলেছেন গাড়িতে যখন ছিলেন তাঁর চোখ বাঁধা ছিল।’
পুলিশ জানায়, রুকুনুজ্জামান পুলিশকে বলেছেন যে গত সোমবার সকালে ঢাকার উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসা থেকে তিনি হাঁটার জন্য বের হন। তখন তাঁকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয় কিছু লোক। মাইক্রোবাসে তোলার পরপর তাঁর চোখ বেঁধে ফেলা হয়। তিনি অপহরণকারীদের কাউকে চিনতে পারেননি। এরপর গতকাল শ্রীমঙ্গলের কালীঘাট ইউপি কার্যালয়ের সামনে তাঁকে কালো একটি মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, থানায় নেওয়ার পর তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে মৌলভীবাজারে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিকেলে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল সাংবাদিকদের বলেন, মেয়র অভিযোগ করেছেন, তাঁকে মারধর করা হয়েছে। উদ্ধারের পর তাঁকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। তাঁর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। তবে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করলে অসংলগ্ন উত্তর দিচ্ছেন। তাঁর কাছে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টরেলের ওষুধ ছিল। তিনি ওষুধ খেয়েছেন।
সন্ধ্যা সাতটায় পুলিশ সুপার জানান, মেয়র রুকুনুজ্জামানকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রুকুনুজ্জামান একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। তিন বছর আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং এই দল থেকে প্রার্থী হয়ে সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। তাঁর পোশাক কারখানা ও বায়িং হাউসের ব্যবসা আছে।