মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের সমাধান কোন পথে, তা জানতে আজ বৃহস্পতিবার সবার নজর থাকবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ওপর। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আজ উন্মুক্ত আলোচনা হতে যাচ্ছে। ২০০৫ সালের পর রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ এই প্রথমবারের মতো পূর্বনির্ধারিত আলোচ্যসূচিতে এসেছে। ১৩ সেপ্টেম্বরের পর এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আলোচনা করতে যাচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদ। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের কাছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আশা করছে বাংলাদেশ।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সাত সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, মিসর, কাজাখস্তান ও সেনেগাল ২৩ সেপ্টেম্বর ওই আলোচনার প্রস্তাব দেয়। এসব দেশ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির বিষয়ে পরিষদকে বিস্তারিত জানানোরও অনুরোধ জানায়। মহাসচিব গুতেরেস আজকের অধিবেশনের শুরুতে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরবেন। আর অধিবেশন শেষে একটি বিবৃতি প্রচার হতে পারে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, রাখাইনে সহিংসতা বন্ধের মিথ্যা দাবি করছে মিয়ানমার। গতকাল বুধবারও রাখাইনে সহিংসতার পাশাপাশি বাড়িঘর পোড়ানোর খবর পাওয়া গেছে। এই পরিস্থিতিতে গতকাল দুপুরে ঢাকায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ওই ব্রিফিংয়ে তিনি বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে জোরালো পদক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি জানান, নিরাপত্তা পরিষদের সভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন সরকারের অবস্থান তুলে ধরবেন।
এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে তুরস্ক ও জাপান। গতকাল ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকে তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রী রিসিপ আকদাগ এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে বৈঠকে জাপানের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় উপমন্ত্রী ইয়াও রাই এ আশ্বাস দেন।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিরাপত্তা পরিষদের কাছে জোরালো পদক্ষেপ বলতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রস্তাব গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করছে। আজ উন্মুক্ত আলোচনার পর ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ শেষ পর্যন্ত কোনো প্রস্তাব নেয় কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষায় এখন সবাই। নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল সন্ধ্যায় অবশ্য আভাস দিয়েছে, আজ বৃহস্পতিবারের আলোচনা শেষে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো প্রস্তাব না-ও হতে পারে। এখনই মিয়ানমারের ওপর বেশি চাপ দিলে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি বিপাকে পড়েন কি না, সেটি নিয়েও পাশ্চাত্যে অনেকে ভাবছেন। সু চির দল এনএলডি সরকার চালালেও কার্যত রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব অটুট আছে। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের ওপর বাইরের চাপ সেনাবাহিনীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নেওয়ার পথ করে দেবে, অনেকে এমন আশঙ্কাও করছেন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের এক রাষ্ট্রদূত মনে করেন, নিরাপত্তা পরিষদ শেষ পর্যন্ত কোনো প্রস্তাব না আনলে যত আলোচনাই হোক, তার কোনো গুরুত্ব শেষ পর্যন্ত থাকবে না। রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের চাপে ১৩ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের পর বিবৃতিটি এসেছিল। ওই আলোচনায় ১০ অস্থায়ী সদস্যের অন্যতম মিসর জোরালো বিবৃতি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এর বিরোধিতা করে পাঁচ স্থায়ী সদস্যের অন্যতম চীন। ফলে চীন আর রাশিয়া যতক্ষণ পর্যন্ত মিয়ানমারের পক্ষে জোরালোভাবে থাকবে, সে সময় পর্যন্ত দেশটির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো জোরালো পদক্ষেপ আশা করাটা বাড়াবাড়ি।
তাঁর মতে, নিরাপত্তা পরিষদের কাজের প্রক্রিয়া অনুযায়ী বিবৃতি হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল পদক্ষেপ। জাতিসংঘের এই ফোরাম থেকে জোরালো কিছু আশা করার মানেই হচ্ছে সুনির্দিষ্ট বিষয় ধরে প্রস্তাব, যা এখন পর্যন্ত হয়নি। আর এটা না হওয়া পর্যন্ত যত বিবৃতিই আসুক না কেন, তা শুধু নৈতিক চাপ তৈরি করবে। এর বেশি কিছু নয়।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন, জাতিসংঘের রাজনৈতিক ফোরাম থার্ড কমিটির বৈঠক আগামী ২ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষ থেকে সৌদি আরব প্রস্তাব দেবে। ওআইসির প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধ, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দলকে মিয়ানমারে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া, আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানের আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের রাজনৈতিক ফোরাম থার্ড কমিটিতে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা মনে করেন, এখানে যতই আলোচনা হোক, তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত নৈতিক চাপেই সীমিত থাকবে। পদক্ষেপ নেওয়ার জায়গা শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদই।
তাঁদের মতে, বাস্তবতা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ওপর চরম নৃশংসতা শুরুর এক মাস পেরিয়ে গেলেও আসিয়ান দেশগুলো এখনো মিয়ানমারের পক্ষেই আছে। শুধু মালয়েশিয়া এ নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া একটা শক্ত অবস্থান নিলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলো এ নিয়ে অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে ভাবত। কারণ, আসিয়ানে ইন্দোনেশিয়াই নেতৃত্ব দিয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, চীন, আসিয়ান এসব সমীকরণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা করেও পার পেয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার। তাই এবারের সংকটের পর বাংলাদেশের বুঝে নেওয়া উচিত, খুব সহজেই এর সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা কম। লড়াইটা দীর্ঘ হবে, সেভাবেই আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতিটা নিতে হবে।
ইউরোপের একটি দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের এক রাষ্ট্রদূতের মতে, পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে মূল্যবোধএখনো গুরুত্বপূর্ণ বলেই সব সময় এরা রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ থেকেছে। এবারও বিশ্বজনমত গঠনে এসব দেশের ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বক্তৃতায় অবশ্য এ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। যদিও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি জাতিসংঘে এ নিয়ে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের এক রাষ্ট্রদূত অবশ্য তাঁর অন্য দুই সহকর্মীর সঙ্গে কিছু ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশ এখনই তার প্রত্যাশা অনুযায়ী মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ার মানে কিছুই হলো না এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না। কারণ, ২০০৫ সালের পর মিয়ানমার নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে উন্মুক্ত আলোচনা কম কথা নয়। এটিকে প্রথম পদক্ষেপ ধরে বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে। বিশ্ববাসীও বুঝতে পারবে সমস্যার ভয়াবহতা। তা ছাড়া ভূরাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চীন ও রাশিয়ার অবস্থানকে মনে রাখতে হবে। ‘
ইউএনএইচসিআরের সংশয়
জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডিবাংলাদেশ সফর শেষে গতকাল জেনেভায় ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, দ্রুত সেটার সমাধান হওয়া দরকার। তবে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে দেওয়া হবে কি না, সেটা এখন ‘বড় প্রশ্ন’। ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, সমস্যাটির সমাধান না হলে ওই অঞ্চলে সন্ত্রাসী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক অনেক বেশি।
জাতিসংঘের ত্রাণ দল মিয়ানমারে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছে
এএফপি জানায়, জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থার প্রতিনিধিরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছেন আজ বৃহস্পতিবার। সম্প্রতি রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর এই প্রথম রাজ্যটিতে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছেন তাঁরা।
জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক গতকাল বুধবার বলেন, ‘মিয়ানমার সরকারের আয়োজনে সম্ভবত আগামীকাল (আজ বৃহস্পতিবার) রাখাইনে জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থার প্রতিনিধিরা যাবেন।’ এক নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ওই এলাকায় আরও অবাধ ও বিস্তৃত প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে এটা প্রথম পদক্ষেপ হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।’