দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় তিন লাখ মোটরসাইকেল বিপণন হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে মোটরসাইকেলের বাজার সম্প্রসারণ হয়েছে বার্ষিক ১৫-২০ শতাংশ হারে। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ততার সুযোগ ও চলিষ্ণুতা বৃদ্ধি, তরুণদের আগ্রহ, রেমিট্যান্সের প্রভাব, সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুবাদে মোটরসাইকেলের বার্ষিক বাজার বেড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ বাজারের ৮৭ শতাংশই এখনো বিদেশী কোম্পানিগুলোর দখলে।
বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএএমএ) তথ্যে দেখা গেছে, দেশে বিপণনকৃত মোটরসাইকেলের ৮৭ শতাংশই আমদানিকৃত। বাকি ১৩ শতাংশ বাজার রয়েছে দেশে উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে। ব্র্যান্ডভিত্তিক হিসেবে দেশের মোটরসাইকেল বাজারের শীর্ষে রয়েছে ভারতীয় কোম্পানি বাজাজ। কয়েক বছর ধরে প্রায় ৪০ শতাংশ বাজার দখলে রাখলেও চলতি বছর তা ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশের বাজারে বিক্রিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা ব্র্যান্ড টিভিএস কয়েক বছর ধরেই ২৪-২৫ শতাংশ বাজার দখলে রেখেছে। চলতি বছরেও দেশে বিক্রীত মোটরসাইকেলের প্রায় ২৪ শতাংশ টিভিএস ব্র্যান্ডের। অন্যান্য ব্র্যান্ডের মধ্যে সুজুকির বাজার ৮, ইয়ামাহার ৯ ও হোন্ডার ১০ শতাংশ। এছাড়া হিরো ৪, রানার ৪ ও অন্যান্য ব্র্যান্ডের ৪ শতাংশ বাজার দখল রয়েছে। অন্যান্য ব্র্যান্ডের মধ্যে ডায়াং, ওয়ালটন ও মাহিন্দ্র উল্লেখযোগ্য। দাম ও মানে ভোক্তা সন্তুষ্টি এবং সর্বোত্তম বিক্রয়োত্তর সেবা এবং খুচরা যন্ত্রাংশের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে পারলে মোটরসাইকেল বাজারে এগিয়ে থাকা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বিএমএএমএর তথ্যমতে, ২০১৪ সালে দেশে ২ লাখ ৫০ হাজার মোটরসাইকেল বিপণন হলেও ২০১৫ সালে এ সংখ্যা কমে ২ লাখ ২৫ হাজারে নামে। আবার ২০১৬ সালে মোটরসাইকেল বিক্রির সংখ্যা ৩ লাখ ২০ হাজারে উন্নীত হয়। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার মোটরসাইকেল।
ক্রেতাদের পছন্দ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫ সালে ৮০, ১০০ ও ১১০ সিসির মোটরসাইকেল চাহিদা সবচেয়ে বেশি ছিল। সে বছর বিক্রীত মোটরসাইকেলের প্রায় ৫০ শতাংশ এই ক্যাটাগরির। এছাড়া বাজারে বিক্রীত প্রায় ১৭ শতাংশ মোটরসাইকেল ছিল ১২৫ থেকে ১৩৫ সিসি সক্ষমতার এবং প্রায় ৩৩ শতাংশ ছিল ১৫০ সিসির। তবে চলতি বছর ১৫০ সিসি বাইকের বাজার অধিগ্রহণ ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বিক্রি হওয়া সব ধরনের মোটরসাইকেলের শোরুম মূল্য হিসাব করলে বাংলাদেশে পণ্যটির বাজার দাঁড়ায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার।
এ বিষয়ে ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই মোটরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ফা হ আনসারী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের অর্থনীতিকে আরো সম্প্রসারণ করতে হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও যুবকদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরো গতিশীল রাখতে হবে। সেটি করতে সবার আগে প্রয়োজন মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলের বাজার দেশে দ্রুত বর্ধন হতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় যেখানে প্রতি হাজারে পাঁচ-ছয়জন মোটরসাইকেল ক্রয় করছে, সেখানে বাংলাদেশে এ হার এখনো হাজারে একজন। মোটরসাইকেলের বাজার সম্প্রসারণের এ সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারের নীতিসহায়তা পর্যাপ্ত নয়। মোটরসাইকেলকে বিলাসপণ্যের পরিবর্তে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে শুল্কহার সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। গণমুখী যানবাহন হিসেবে এর প্রচলন করতে পারলে অর্থনীতি আরো বেগবান হবে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে ১০০ সিসি আমদানিকৃত মোটরসাইকেলের দাম গড়ে ১ হাজার ৮১৫ ডলার। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একই মোটরসাইকেলের দাম ৯৪০ ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানে এ মোটরসাইকেলের দাম মাত্র ৮০০ ডলার। শ্রীলংকা ও নেপালে পণ্যটির দাম গড়ে যথাক্রমে ১ হাজার ৩৯৬ ও ১ হাজার ৪৫২ ডলার। মোটরসাইকেলের দামের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন ও অন্যান্য খরচ যুক্ত করলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পণ্যটির দাম সবচেয়ে বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে মোটরসাইকেল উত্পাদন উৎসাহিত করতে সরকার বাহনটির যন্ত্রাংশ আমদানির শুল্ক কিছুটা কমিয়েছে। এজন্য বাজাজ, টিভিএস, হোন্ডা ও হিরোর মতো বিদেশী কোম্পানিগুলো দেশেই কারখানা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে মোটরসাইকেল উত্পাদনকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আগে বিভিন্ন সহযোগী শিল্পকে উন্নত করতে হবে। দেশে এখনো এমন শিল্পের অভাব রয়েছে। মোটরসাইকেল প্রস্তুতে ইঞ্জিন থেকে শুরু করে চেইন, সিট কভার, যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য নানা উপাদানের প্রয়োজন পড়ে। দেশে এ উপাদানগুলোর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে না উঠলে দেশীয় মোটরসাইকেল শিল্প গড়ে তুলতে হিমশিম খেতে হবে।
এ বিষয়ে বিএমএএমএর কোষাধ্যক্ষ ও টিভিএস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা (সিইও) বিপ্লব কুমার রয় বলেন, দেশে আমদানিকৃত মোটরসাইকেলে এখন সবমিলে ১৪২ শতাংশ শুল্ক ধার্য আছে। ফলে এ খাতের শিল্পটি যেভাবে সম্প্রসারণ হওয়ার কথা, সেভাবে হচ্ছে না। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা করতে হবে। পাশাপাশি ভেন্ডরনির্ভর ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে তুলতে হবে। তাহলে দেশে মোটরসাইকেল উত্পাদন টেকসই হবে।