রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ‘শরণার্থী’র মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সরকার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু এই সম্প্রদায়কে শরণার্থী বলতে চায় না। আর জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) বলছে, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, নিপীড়ন আর সহিংসতা থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা লোকজন শরণার্থী।
রোহিঙ্গাদের মর্যাদার বিষয়ে যতই টানাপোড়েন থাকুক, এবার নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াসহ তাদের ব্যবস্থাপনায় এর মধ্যেই বড় পরিসরে যুক্ত করা হচ্ছে ইউএনএইচসিআরকে। কক্সবাজারের নতুন অস্থায়ী শিবিরে ঘর তৈরিতে সংস্থাটি যুক্ত হচ্ছে। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আবাসনসহ জরুরি মানবিক সাহায্যের কাজে যুক্ততার বিষয়ে গতকাল সোমবার একাধিক বৈঠক করেছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি। এর আগে শুধু কক্সবাজারের দুটি নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরেই ইউএনএইচসিআর কাজ করে আসছে। রোহিঙ্গাদের শরণার্থীর মর্যাদা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই এভাবে ইউএনএইচসিআরের যুক্ততা নিয়ে সরকারের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ আছে।
গতকাল সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব মো. শাহ কামাল বলেন, রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এখন পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যদি দেখা যায় বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে, তখন তাদের শরণার্থী ভাবার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডির কাছে রোহিঙ্গাদের শরণার্থীর
মর্যাদার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। ফিলিপ্পো বলেন, ‘রাখাইন রাজ্য থেকে বিভিন্ন সময়ে যারা পালিয়ে এসেছে, ইউএনএইচসিআর তাদের শরণার্থী বিবেচনা করে। বঞ্চনা, নিপীড়ন, সহিংসতা, সংঘাত—এসব কারণে যেসব লোক প্রাণ বাঁচাতে এসেছে, তাঁরা শরণার্থী। তবে তাদের মর্যাদা কী হবে, সেটি ঠিক করা সরকারের সার্বভৌম সিদ্ধান্তের বিষয়।’ তিনি আরও বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের শরণার্থীর স্বীকৃতি দেওয়া হোক বা না হোক, সেটা আমাদের কিংবা সরকারকে তাদের সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেয় না। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
গত শনি ও রোববার কক্সবাজার ঘুরে এসে গতকাল সোমবার রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান কথা বলেন। জাতিসংঘে দেওয়া বক্তৃতায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। আর এই প্রস্তাবের অন্যতম বিষয় মিয়ানমারের ভেতরে একটি ‘সুরক্ষা বলয়’ প্রতিষ্ঠা করা। দুই দিন আগে জেনেভায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার এক কর্মকর্তা প্রস্তাবের বিপক্ষে মত দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফিলিপ্পো বলেন, ‘আমরা এটার বিরোধিতা করছি না। আমাদের বুঝতে হবে কীভাবে একটা অঞ্চলকে নিরাপদ রাখা যায়। এটা কিন্তু ইউএনএইচসিআর ঠিক করবে না। মিয়ানমার সরকার আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আলাপ-আলোচনা করে এটা ঠিক করবে।’
দৃষ্টান্ত দিয়ে ফিলিপ্পো বলেন, সিরিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে ‘সুরক্ষা বলয়’ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে আপনি একটা জায়গাকে নিরাপদ রাখবেন? এ ক্ষেত্রে পথ কিন্তু দুটি। হয় ওই দেশের সরকারকে লোকজনের নিরাপত্তায় তা করতে হবে। কিংবা কোনো দেশ এটা করতে রাজি না হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে দেশে হস্তক্ষেপ করে সেটা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাঁর মতে, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব আনতে হবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটা জটিল। এ জন্য আমরা মানবিক সহায়তাদানকারীদের কাজ শুরু করার অনুমতি চাই। আমরা সামগ্রিকভাবে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা চাই। এটা না হলে লোকজন ফিরে যাবে না। কারণ লোকজন তো সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে তারা ফিরবে না।’
কেন শরণার্থী নয়?
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ১৯৯২-৯৩ সালের খারাপ অভিজ্ঞতাকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের মতে, ওই সময় রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের শরণার্থীর স্বীকৃতি দেওয়ার পর তাদের ফেরত পাঠাতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত লেগেছে। এক যুগের বেশি সময় নিয়েও সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। কারণ শরণার্থীর স্বীকৃতি দেওয়ার পর তাদের প্রত্যাবসনের বিষয়টি ইউএনএইচসিআরের হাতে চলে যায়। আর জাতিসংঘের শরণার্থী সনদ অনুযায়ী জোর করে শরণার্থীদের ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই।
সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের শরণার্থীর মর্যাদা না দিলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের এসব নাগরিককে বাংলাদেশে কীভাবে দেখবে আর সহায়তা দেবে, সেটিও ভাবা হচ্ছে। তা ছাড়া, অতীতে কখনো এত বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেনি। তাই হুটহাট এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যৌক্তিক হবে না। তা ছাড়া, জাতিসংঘে দেওয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর করে এসব নাগরিককে মিয়ানমার থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ওই কর্মকর্তার মতে, শরণার্থীর স্বীকৃতি না দিলেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের মাধ্যমে গৃহহীন করার ইঙ্গিত আছে।
তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের শরণার্থীর বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কথা জানা থাকলেও মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে অন্য তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল কক্সবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিবন্ধনে এর মধ্যেই ইউএনএইচসিআর কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। নিবন্ধন শেষ হলে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের দেখভালের দায়িত্ব জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাকে দেওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের প্রায় ৩ লাখ অনিবন্ধিত লোকের দেখাশোনার কাজটি করছে। এবার প্রায় সাড়ে ৪ লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে আসায় তাদের ব্যবস্থাপনা আইওএমের পক্ষে সম্ভব নয় বলে সরকারের কোনো কোনো পক্ষ মনে করছে।
মিয়ানমারে যাওয়া হলো না
ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার উৎস ও সমাধান মিয়ানমারের হাতে। তাই সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারকে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। রাখাইনে মানবিক সহায়তার কাজে লোকজনকে অবাধে কাজ করতে দিতে হবে।
ফিলিপ্পো বলেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় সাড়ে ৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ-সহায়তা আরও বাড়ানো দরকার। দ্রুত তা এনে সমন্বিত উপায়ে বণ্টন করা জরুরি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের জন্য জরুরি তহবিলের ঘোষণা দেওয়া হবে।
সাম্প্রতিক কক্সবাজার সফরের কথা উল্লেখ করে ফিলিপ্পো বলেছেন, বাংলাদেশের ছোট এই ভৌগোলিক পরিসরে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিয়েছে। তিনি পালিয়ে আসা লোকজনের মুখে দারুণভাবে মন খারাপ করা সব বর্ণনা শুনেছেন। তাদের সেই বর্ণনায় শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন আর সব ধরনের ভয়ভীতির পাশাপাশি নৃশংসতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, রোহিঙ্গারা নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যাক। তাই মিয়ানমারকে অবশ্যই সহিংসতা বন্ধ করতে হবে এবং পরিস্থিতি যাতে স্থিতিশীল হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’
রোহিঙ্গাদের শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া, তাদের সুরক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা করলেও এ নিয়ে কথা বলতে মিয়ানমারে যেতে পারেননি ফিলিপ্পো। ইয়াঙ্গুনের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, তিনি আলোচনার জন্য দেশটিতে যাওয়ার আগ্রহ দেখালেও সাড়া দেয়নি মিয়ানমার সরকার।
এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ফিলিপ্পো বলেন, ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সফর ঠিক হয়েছে। আমি মিয়ানমারে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে সেখানকার সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করা যায়নি। আমি সেখানে যাওয়ার আশা রাখি। যত শিগগির সম্ভব আমি সেখানে যাব।’