দালাল না ধরে বা ঘুষ না দিয়ে মাসুম রানা পাসপোর্ট করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দালাল ছাড়া কাজ করাতে পারলেও পুলিশি যাচাই-বাছাইয়ের (ভেরিফিকেশন) সময় ঘুষ থেকে রেহাই পাননি। মাসুমের প্রশ্ন, ‘আমি যদি পাসপোর্টের জন্য সকল ভ্যালিড ডকুমেন্টস সাবমিট করি, তাহলে আবার ভেরিফিকেশন কেন?’
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাসুম রানা গত মে মাসে পাসপোর্ট করতে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দেড় হাজার টাকা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসে কোনো রকম ভুল না হলে ঝামেলা ছাড়াই প্রথম ধাপ শেষ করা যায়। কিন্তু বিপত্তি বাধে পুলিশের যাচাই-বাছাইয়ে। টাকা ছাড়া কোনোভাবেই সঠিক প্রতিবেদন দিতে চান না বা অযথাই দেরি করেন। তিনি আরও বলেন, তাঁর বর্তমান ঠিকানা রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আর স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লায়। দুই জায়গায় যাচাইয়ের জন্য তাঁকে দেড় হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
ঘুষের ঝামেলায় ক্ষুব্ধ মাসুম বলেন, ‘অপরাধীদের ডেটাবেইস পাসপোর্ট অফিসকে দিয়ে দিলেই হয়। তাহলে বেশির ভাগ মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে হয় না।’
সালমা খাতুনকে স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানার তদন্তের জন্য ৩ হাজার ৮০০ টাকা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৫০০ টাকা। সালমা বলেন, ‘যিনি তদন্তের জন্য এসেছিলেন, তিনি সরাসরি বলেছেন, টাকা না দিলে রিপোর্ট দেরি করে দেবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত ২১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে ‘পাসপোর্ট সেবায় সুশাসন: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ পুলিশি তদন্তের প্রতিবেদনের জন্য ঘুষ দেন। ঘুষের গড় পরিমাণ ৭৯৭ টাকা। ৭৬ শতাংশ গ্রাহকই পুলিশি তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হন। প্রতিবেদনটিতে দালাল বা অন্যের মাধ্যমে পাসপোর্ট করানোর চিত্রও উঠে এসেছে। ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ সেবাগ্রহীতা দালাল বা অন্যের সহযোগিতা নিয়েছেন।
পাসপোর্টে পুলিশি তদন্তের প্রয়োজন আছে কি না, তা জানতে চাইলে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাসুদ রেজওয়ান বলেন, এখনো অনেক ভুয়া জন্মসনদ হয়। এর জন্যই প্রয়োজন আছে। তবে তিনি এও বলেন, সবার স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র হয়ে গেলে পুলিশি তদন্তের প্রয়োজন আছে কি না, সে ব্যাপারে চিন্তা করা হতে পারে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তা থেকেই দালালেরা ছেঁকে ধরেন। তাঁদের একজন মো. নাসির। কীভাবে তাঁরা পাসপোর্ট করিয়ে দেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণভাবে করতে গেলে ৮ হাজার ও জরুরি করতে গেলে ১৩ হাজার টাকা লাগে। আঙুলের ছাপ দেওয়ার জন্য লাইন ধরতে হবে না। পুলিশি তদন্তের ভারও তাঁদের ওপর। তাঁরাই স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানায় তদন্তের প্রতিবেদন আনবেন।
পুলিশি এই তদন্ত নিয়ে অভিযোগ অনেকেরই। ভুক্তভোগী কয়েকজন বলেন, সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরেও এই তদন্ত ভোগান্তি বাড়ায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পাসপোর্টগ্রহীতা বললেন, ‘এটা ভেরিফিকেশন না, হয়রানির করে ঘুষ খাওয়ার একটা উপায়।’
যাচাই-বাছাইয়ের হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে দুদিন সময় দিয়েও ব্যস্ততার কারণে কথা বলতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন।