প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অব্যাহত নির্যাতন বন্ধের জন্য নিরাপত্তা পরিষদ ও জাতিসংঘ মহাসচিবের ‘দ্রুত ও কার্যকর’ হস্তক্ষেপের আহ্বান করেছেন।
বাংলাদেশ সময় গতকাল শুক্রবার এক আবেগঘন ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত নির্যাতনের ফলে সে দেশ থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। শরণার্থীদের বেদনা তিনি বোঝেন, ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর নিজের ছোট বোনকে নিয়ে তাঁকে ছয় বছর শরণার্থীর জীবন কাটাতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এর মধ্যে রয়েছে: রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধন অবিলম্বে ও চিরতরে নিঃশর্তে বন্ধ করা, জাতিসংঘ মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ, মিয়ানমারের ভেতরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘সুরক্ষা বলয়’ প্রতিষ্ঠা, বিতাড়িত সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিজ বাসগৃহে পুনর্বাসন ও কফি আনান কমিশনের সুপারিশের ‘নিঃশর্ত, পূর্ণাঙ্গ ও দ্রুত’ বাস্তবায়ন।
একই দিন সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে দেখা করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেন। এ ব্যাপারে তিনি মহাসচিবের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের অনুরোধ করেন। মহাসচিবের একজন মুখপাত্র জানান, এই সাক্ষাতের সময় আন্তোনিও গুতেরেস রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করেন। এই প্রশ্ন সমাধানে জাতিসংঘের সব সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে মহাসচিব অবিলম্বে কফি আনান কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নেরও তাগিদ দেন।
শুধু তাঁর ভাষণে নয়, প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে অবস্থানকালে প্রায় সব ফোরামেই রোহিঙ্গা প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও তিনি রোহিঙ্গা প্রশ্নে স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতার অনুরোধ করেন।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদ কতটা কার্যকর উদ্যোগ নেবে, তা অনেকটা নির্ভর করবে এই অঙ্গসংগঠনের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ভূমিকার ওপর। ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদ ইতিমধ্যে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে, কিন্তু কী আলোচনা হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। পরিষদের অন্যতম সদস্য যুক্তরাজ্য পরে জানায়, এই বৈঠকে সব সদস্যরাষ্ট্রই সহিংসতা বন্ধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের সেনাবাহিনীর প্রতি রাশিয়া ও চীনের নমনীয় অবস্থানের কারণেই নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত কোনো অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হয়নি।
ভারত রাখাইনের সহিংসতা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে, বাংলাদেশে ত্রাণ পাঠিয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গেই আছে। রয়টার্স বৃহস্পতিবার এক খবরে জানিয়েছে, মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি বিবেচনা করছে ভারত। মিয়ানমারের নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল তিন অং সান গত বুধবার ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের সঙ্গে দেখা করেন। এ ছাড়া ভারতের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে মিয়ানমারকে টহল নৌযান সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা হয়।
রাশিয়া ও চীনের তুলনায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে মার্কিন অবস্থান অনেক স্পষ্ট। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স নিরাপত্তা পরিষদে শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রশ্নে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলাকে ‘ভয়াবহ বর্বরতা’ হিসেবে অভিহিত করে সহিংসতা বন্ধ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন। শান্তি নিশ্চিত না হলে এই সহিংসতার আগুন পুরো অঞ্চলকেই পুড়িয়ে মারবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন পেন্স। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে অবশ্য রোহিঙ্গা প্রশ্নে এখন পর্যন্ত কিছু বলেননি। সাধারণ পরিষদে তাঁর ৪২ মিনিটের ভাষণে তিনি একবারের জন্যও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি। এ ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কতটা সাহায্য পাওয়া যাবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও।
উত্তর কোরিয়া থেকে ভেনেজুয়েলা পর্যন্ত বিভিন্ন ‘বৈরী’ দেশের ব্যাপারে কড়া কড়া কথা বললেও মিয়ানমারের ব্যাপারে ট্রাম্প নিজে কেন কোনো কথা বলছেন না, বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সে প্রশ্নের মুখোমুখি হন জাতিসংঘে মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হেলি। ট্রাম্পের ভাষণ রচনায় তাঁর কোনো হাত ছিল কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে সরাসরি জবাব দেওয়ার বদলে রাষ্ট্রদূত হেলি বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তিনি এ নিয়ে কথা বলেছেন, এ নিয়ে কী করা হচ্ছে তা জানতে চেয়েছেন।’ নিকি হেলি জানান, রোহিঙ্গা প্রশ্নে কথা বলার দায়িত্ব তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সের ওপর দিয়েছেন।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে নিকি হেলি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রশ্নে কথা বলেছেন। মার্কিন যৌথ সেনাবাহিনীর প্রধান ডানফোর্ড মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সঙ্গে টেলিফোনে সহিংসতা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা প্রশ্নে কতটা গুরুত্ব দেয়, তা নিয়ে প্রথম আলো মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলেছে। এই দপ্তরের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সংবাদমাধ্যমের মুখপাত্র হেলেনা হোয়াইট এই প্রতিবেদকের কাছে এক লিখিত মন্তব্যে জানিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক ব্যক্তিদের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, নির্বিচার নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনায় আমরা শঙ্কিত। যে হারে মানুষ গৃহহীন হচ্ছে তা থেকে স্পষ্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। হেলেনা হোয়াইট জানান, যুক্তরাষ্ট্র আইনের শাসনের প্রতি সম্মান দেখানোর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।’
শেখ হাসিনা সাধারণ পরিষদে তাঁর ভাষণে সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের ওপর জোর গুরুত্ব দিলেও এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের জন্য দ্রুত মানবিক সাহায্য প্রদান। জাতিসংঘের একাধিক অঙ্গ সংস্থা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠন এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়েছে।
তবে রোহিঙ্গা প্রশ্নে এই মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে না, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিক কী করা যায়, সে প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে এখনো স্পষ্ট ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। ওয়াশিংটনভিত্তিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের অন্যতম বিশেষজ্ঞ রেক্স রিয়েফেল প্রথম আলোর কাছে এক লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছেন, তাঁর বিবেচনায় এই মুহূর্তে ‘সুবুদ্ধিসম্পন্ন’ সমাধান অর্জন অসম্ভব। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণের সম্ভাবনাও কার্যত শূন্য। এই মুহূর্তে যা রাজনৈতিকভাবে অর্জন সম্ভব তা হলো, বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ব্যাপক আন্তর্জাতিক ত্রাণ তৎপরতা। তেমন ত্রাণ তৎপরতা গ্রহণ সম্ভব হলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে, তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।