আরো জোর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নেপিদো। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়ে বিশ্বনেতাদের কাছে জোর আবেদন জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। গতকাল এক বিবৃতির মাধ্যমে এ আবেদন জানায় সংস্থাটি। বিবৃতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নিধন কর্মসূচি’র আওতায় ৪ লাখ ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে দেশটি থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ এনেছে এইচআরডব্লিউ। খবর এএফপি।
এইচআরডব্লিউ এমন এক সময় এ আহ্বান জানাল, যেদিন সন্ধ্যায় রাখাইন অঞ্চলের সংঘাত নিয়ে মিয়ানমারের বেসামরিক প্রশাসনের নেতা অং সান সু চির নিজ জাতির উদ্দেশে বহুপ্রতীক্ষিত ভাষণ দেয়ার কথা। চলমান সংকট শুরুর পর থেকে নিজ জাতির উদ্দেশে এটিই তার প্রথম ভাষণ হতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও এখন প্রস্তুতি চলছে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শুরুর। এ অধিবেশনে আলোচ্য ইস্যুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দলে দলে মিয়ানমার থেকে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ঘটনাটি জন্ম দিয়েছে এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের। প্রতিদিনই দেশটি থেকে প্রচুর রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। এসব শরণার্থীর মধ্যে অধিকাংশই শিশু। সাহায্য সংস্থাগুলোও এখন এ অবস্থায় শরণার্থী শিবিরগুলোয় ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সবাইকে ফেরত নেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার। গত মাসে দেশটির কয়েকটি পুলিশ পোস্টে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জন্য এ শরণার্থীদেরই দায়ী করছে সংস্থাটি।
শরণার্থীদের স্বভূমে পাঠানোয় বাধাদানের যেকোনো ধরনের অপপ্রয়াস নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন। সেখানে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সবাইকে ফেরত নেয়ার বিষয়ে রাজি করানোর জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা চাইবেন প্রধানমন্ত্রী।
অন্যদিকে বিবৃতিতে বাস্তুচ্যুত শরণার্থী রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছাপ্রত্যাবাসন নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। একই সঙ্গে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে ‘চলমান বর্বরতার’ জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে শাস্তি দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বর্মি সেনাবাহিনীকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান জাতিগত নিপীড়ন বন্ধে বাধ্য করা।’
প্রায় ৫০ বছর ধরে সামরিক শাসন চালানোর কারণে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা অবরোধের মুখে ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সম্প্রতি দেশটির সামরিক জেনারেলরা মিয়ানমারে গণতন্ত্র আংশিক প্রচলনে সম্মতি জানালে এসব অবরোধের মধ্যে অনেকগুলোই তুলে নেয়া হয়।
বিবৃতিতে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ প্রসঙ্গে এইচআরডব্লিউর এশিয়া অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর জন সিফটন বলেন, ‘আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করলেই আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বানের মুখে নতি স্বীকার করে নেবেন বার্মার জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডাররা।’
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান বর্বরতা সত্ত্বেও এ বিষয়ে মুখ খোলেননি মিয়ানমারের নেত্রী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি। তার এ নীরবতা ও সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের নিন্দা জ্ঞাপনে অসমর্থতা বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহলে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। সু চি বর্তমানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভাগাভাগির ভিত্তিতে মিয়ানমারের শাসনক্ষমতা পরিচালনা করছেন।
এদিকে আজ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নিজ জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ দেয়ার কথা সু চির। সম্প্রতি এক সাক্ষাত্কারে ভাষণটিকে মানবিক সংকটের সমাধানে দেয়ার সু চির জন্য সর্বশেষ সুযোগ বলে অভিহিত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
কিন্তু সু চির পক্ষে বৈরী বৈশ্বিক জনমত ও অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় উত্তেজনাপূর্ণ সংকট— দুটোকেই একসঙ্গে সামাল দেয়া অনেক কঠিন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ সেনাবাহিনীর এ অভিযানে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর অনেকেরই সমর্থন রয়েছে।
এ বিষয়ে মিয়ানমার বিশ্লেষক রিচার্ড হর্সি বলেন, ‘আশঙ্কার বিষয় হলো, মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটাই এমন যে, সেখানে আন্তর্জাতিক মহল ও দেশের অভ্যন্তরের সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রত্যাশার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।’