মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কমপক্ষে দুটি গ্রামে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম। বৌদ্ধদের শত্রুতাপূর্ণ অবস্থানের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এ দুটি গ্রাম। সেখানে খাবার ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এ অবস্থায় তারা সেখান থেকে পালাতে নিরাপদ সুবিধা দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে কর্তৃপক্ষের প্রতি। আহ নাউক পাইন গ্রামের একজন রোহিঙ্গা কর্মকর্তা মুয়াং মুয়াং বলেছেন, আমরা ভয়ে শঙ্কিত। আমাদের খাবার ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। হুমকি দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হবে। আরেকজন রোহিঙ্গা বলেছেন, জাতিগত রোহিঙ্গা বৌদ্ধরা ওই গ্রামে গিয়েছে। তারা চিৎকার করে প্রচার করেছে। বলেছে, পালাও, না হালে আমরা তোমাদের সবাইকে হত্যা করবো। ২৫ শে আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর থেকে আহ নাউক পাইন গ্রামের সঙ্গে পাশর্^বর্তী রাখাইনদের সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ওই এলাকা। ওই সহিংসতা শুরুর পর জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী কমপক্ষে চার লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। একে জাতিসংঘ জাতি নিধন বা জাতি নির্মূল বলে আখ্যায়িত করেছে। এর ওপর আবার মিয়ানমারের সেনা প্রধান মিন অং হ্লাইং ঘোষণা দিয়েছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তাদেরকে ফিরতে দেয়া হবে না। সহিংসতা শুরুর আগে পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইনে বসবাস করতেন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের কোনো অধিকার ছিল না। ছিল না নাগরিকত্ব। চলাচলে কোনো স্বাধীনতা ছিল না। বৌদ্ধরা তাদেরকে দেখে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী হিসেবে। ওদিকে রাখাইন রাজ্য সরকারের সচিব টিন মুয়াং শয়ে বলেছেন, তারা রাথেডাং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন। তবে কোনো রোহিঙ্গা গ্রামের মানুষের নিরাপদে চলে যাওয়ার আবেদন সংক্রান্ত কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। সেখানে কোনো উত্তেজনা নেই বলে জানান তিনি। বলেন, রাথেডাংয়ের দক্ষিণ অংশ পুরোপুরি নিরাপদ। জাতীয় পুলিশের মুখপাত্র মাইয়ো থু শোয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গা গ্রামবাসীর আবেদন সম্পর্কে তার কাছেও কোনো তথ্য নেই। তবু তিনি বিষয়টিতে খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন। উল্লেখ্য, আহ নাউক পাইন গ্রামটি রাথেডাং এলাকায় ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে অবস্থিত। সেখানে আটকে পড়া রোহিঙ্গারা বলেছেন, তাদের পালিয়ে আসার মতো কোনো নৌকা নেই। তিন সপ্তাহ আগেও রাথেডাংয়ে মুসলিমদের ২১টি গ্রাম ছিল। তার মধ্যে ১৬টি গ্রাম ফাঁকা হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেয়া তিনটি শিবির তখন থেকেই ফাঁকা হয়ে গেছে। অনেকগুলো জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে সেখান থেকে কমপক্ষে ২৮ হাজার মানুষ পালিয়েছে। তবে রাথেডাংয়ে রোহিঙ্গাদের ৫টি গ্রাম এবং সেখানে বসবাসকারী ৮ হাজারের বেশি অধিবাসীকে ঘিরে রেখেছে রাখাইন বৌদ্ধরা এবং তারা সত্যিকার অর্থেই বিপন্ন অবস্থায় আছেন। আহ নাউক পাইন ও পাশ^বর্তী নাউং পিন গি গ্রামের পরিস্থিতি করুণ। সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পথ দীর্ঘ, বন্ধুর এবং সে পথে অবরোধ সৃষ্টি করে রেখেছে জাতিগত রাখাইনরা। রোহিঙ্গা কর্মকর্তা মুয়াং মুয়াং বলেছেন, এসব গ্রামের অধিবাসীরা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন। কিন্তু তাদের আবেদনে কর্তৃপক্ষ সাড়া দিচ্ছে না। তাদেরকে নিরাপত্তা দিচ্ছে না। গ্রামবাসী রাতের বেলায় শুনতে পাচ্ছেন অনতিদূরে গুলির শব্দ। রাথেডাংয়ের একজন কর্মকর্তা থেইন অং বলেছেন, এসব মানুষের অন্য কোথাও চলে যাওয়াই উত্তম। উল্লেখ্য, ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) যে হামলা চালিয়েছিল তার মধ্যে শুধু রাথেডাংয়ে দুটি হামলা হয়েছিল। তারপর থেকে ওই এলাকায় ধর্মীয় উত্তেজনা তীব্র থেকে তীব্র হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগ এনেছে আরসা। জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে আসলে রাথেডাংয়ে খাদ্য ও পানি সরবারাহজ সীমিত করা হয়। ওদিকে মুয়াং মুয়াং বলেছে, গ্রামে হুমকির বিষয়ে রিপোর্ট করতে আমি কমপক্ষে ৩০ বার ফোন করেছি পুলিশকে। ১৩ই সেপ্টেম্বর তিনি রাখাইনের একজন গ্রামবাসীর ফোন পান। তাতে ওই ব্যক্তি বলেন, আগামীকালই পালাও, না হলে আমরা এসে তোমাদের সব বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবো। জবাবে মুয়াং মুয়াং বলেন, আমাদের পালানোর কোনো পথ নেই। তার এ কথার জবাবে অন্যপাশ থেকে বলা হয়Ñ সেটা আমাদের সমস্যা নয়। ৩১ শে আগস্ট দু’গ্রামের মানুষকে নিয়ে রাস্তার পাশে একটি বৈঠক করে পুলিশ। তাতে যোগ দেন আহ নাউক পাইন গ্রামের ৭ জন রোহিঙ্গা ও আশপাশ থেকে আসা ১৪ জন রাখাইন কর্মকর্তা। মুয়াং মুয়াং বলেন, ওই সভায় রোহিঙ্গাদের অভিযোগ শোনার পরিবর্তে রাখাইন কর্মকর্তারা আলটিমেটাম দেয়। তারা বলেন, তারা ওই অঞ্চলে কোনো মুসলিমকে দেখতে চান না। তারা অবিলম্বে মুসলিমদের চলে যেতে বলে। এ সময় রোহিঙ্গারা তাদের কথায় রাজি হয়, যদি তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হয়। ৭ই সেপ্টেম্বর রাথেডাং কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রামের বয়স্করা একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠিটি একটি বার্তা সংস্থাকে দেখিয়ে বলেন, তাদেরকে অন্য জায়গা চলে যেতে বলা হয়েছে।