রাখাইনে যুবক দেখলেই গুলি

Slider সারাবিশ্ব
রাখাইনে যুবক দেখলেই গুলি


আবদুল্লাহ আল নোমান। মিয়ানমারের মংডু জেলায় সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

মংডু শহরের উকিলপাড়ায় তার বাড়ি। শ্বশুর বাড়িও সেখানে। স্ত্রী রাফিকা ও তিন সন্তানকে নিয়ে সুখেই ছিলেন তিনি। উচ্চশিক্ষা নিয়েও সরকারি কোনো ভালো চাকরি জোটেনি তার। কারণ, তিনি রোহিঙ্গা। তাই ব্যবসা শুরু করেন। মংডু শহরে একটি বড় জুতার দোকান ছিল তার।গত ২৫ আগস্ট থেকেই ওলটপালট হয়ে যায় সব। তার দোকানে মগ ও উগ্র বৌদ্ধদের সহায়তায় বার্মিজ আর্মি হামলা করে। পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয় দোকান। তাকে গুলিও করা হয়। কিন্তু গুলি তার শরীরে লাগেনি। সেখান থেকে কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে সরাসরি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। ফোনে পরিবারের সবাইকে দ্রুত চলে আসতে বলেন। কিন্তু মিলিটারির হাতে ধরা পড়ার ভয়ে আসতে পারেনি তার পরিবার। এখনো ঘরবন্দী মিয়ানমারে রয়েছেন রাফিকা ও তার তিন সন্তান। প্রতিদিনই টেকনাফের নাফ নদের তীরে নোমানের মতো অনেকেই স্বজনদের চলে আসার অপেক্ষা করছে।

নাইক্কনদিয়া দ্বীপ থেকে মিয়ানমার থেকে আসা একাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাখাইনের তিনটি জেলা মংডু, বুসিদং ও রাসিদংয়ে এখনো অন্তত পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান অবস্থান করছে। ওই তিন জেলায় ৩০ লাখ লোকের মধ্যে ৯৫ ভাগই রোহিঙ্গা মুসলমান। এরমধ্যে ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আরও অন্তত পাঁচ লাখ লোক শহর ও গ্রামে পালিয়ে অবস্থান করছে। আর বাকিরা সীমান্তের বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।

এদিকে টেকনাফের নাফ নদের বিপরীতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী শিলখালী, ডনখালী, নাসিদং এবং উকিলপাড়ায় এখনো প্রতিদিনই আগুন জ্বলতে দেখা যায়। গতকাল সকালে শাহপরীর দ্বীপে সরেজমিনে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা গেছে। দুপুর পর্যন্ত অবস্থানকালেও একই চিত্র দেখা যায়। স্থানীয়রা জানান, এখন প্রতিদিনই ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওইসব গ্রামে আগুন দেয় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। ওই এলাকার প্রায় সব বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। গাছপালাগুলোও পুড়ে লালচে হয়ে গেছে। আগত রোহিঙ্গারা জানান, বার্মিজ আর্মির গুলিতে ‘শহীদ’ হওয়ার রোহিঙ্গাদের বড় অংশই যুবক। রোহিঙ্গা যুবক দেখামাত্রই গুলি করা হয়। তাদের আকুতি-মিনতি করেও লাভ হয় না। বুসিংয়ের মেইটু মনটিং নামে একটি পাহাড়ের পাদদেশে ১২ হাজার যুবককে একসঙ্গে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলা হয় বলেও জানান একাধিক রোহিঙ্গা। আর যুবতী মেয়েদের পেলেই ধর্ষণ করা হয়। অনেককেই হত্যাও করা হয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে ‘বাঙালি রোহিঙ্গা’ বলে বাংলাদেশে চলে যেতে বলা হয়। নইলে তাদেরও মেরে ফেলা হয়। শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে, আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে কেউই এগিয়ে আসছে না। জাতিসংঘ কিংবা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সেখানে কোনো ভূমিকাই নেই। তারা যেভাবে ঘরবন্দী বা পালিয়ে পাহাড়ে কিংবা সীমান্তের কোনো ঝুপড়িতে অবস্থান নিয়েছেন—তাতে যে কোনো সময় ধরা পড়ে যেতে পারেন। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার হাতে পড়লে জীবন বিলিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই। ঘরেবন্দী থাকাদেরও করুণ দশা। একইভাবে নো ম্যান্স ল্যান্ডে আটকে থাকা লক্ষাধিক রোহিঙ্গাও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। রোহিঙ্গাদের ভাষায় তাদের উদ্ধারে বিশ্ববিবেক নীরব। আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উকিলপাড়ায় তার বাড়িতে স্ত্রী ছাড়াও শ্বশুর, শাশুড়ি, বাবা মা নেওয়াজ ও সুদাইস নামে দুই ছেলে এবং রিমা নামে পাঁচ বছর বয়সের এক মেয়ে এখনো ঘরবন্দী হয়ে আছেন। মংডুতে এমন অনেক পরিবারই আছেন, স্বামী কর্মস্থল থেকেই কোনোমতে পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছেন। বাড়িতে পর্যন্ত যেতে পারেননি। তিনি জানান, প্রতিদিনই তিনি শাহপরীর দ্বীপে এসে পরিবাবের জন্য অপেক্ষা করছেন। একাধিকবার ফোনে কথাও বলেন। কিন্তু পরিবার জানায়, তার গ্রামের চারপাশে সেনাবাহিনী অবস্থান করছে। কোনোমতেই বেরোনো সম্ভব নয়। সুযোগ পেলে অবশ্যই তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবেন। শিলখালী থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা শফিকুল ইসলাম নামে এক বৃদ্ধ জানান, নাইক্কনদিয়া দ্বীপেও অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে অবস্থান নিয়েছেন। সেখানেও মাঝে মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হামলা চালাচ্ছে। গত পরশুও চারজন রোহিঙ্গাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। তিনি জানান, ওই দ্বীপে থাকা রোহিঙ্গারা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকেই খাবার না পেয়ে গাছের পাতা খেয়ে থাকছেন। অন্যদিকে সেখান থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও মাঝিরা অমানবিক আচরণ করছে। কারও কাছে টাকা না থাকলে পারাপার করা হয় না। মিয়ানমারের টাকায় ৫০ হাজারের নিচে দিলে কাউকে বাংলাদেশে আনা হয় না। মহিলারা সর্বশেষ অবলম্বন কানের দুল, গলার হার দিয়েও মাঝিদের অনুনয় বিনয় করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন বলে জানান ওই বৃদ্ধ। শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফে জড়ো হওয়া একাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, রাখাইনে অধিকাংশ রোহিঙ্গা দীর্ঘদিন থেকেই নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। তাদের ভাগ্যে সরকারি চাকরি জোটে না। ২০০৬ সালের পর থেকে এখন আর কোনো রোহিঙ্গাই উচ্চশিক্ষাও নিতে পারে না। রাখাইনে তারা চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বসবাস করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *