চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণভাবে আট লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পেরেছেন মাত্র আড়াই লাখ টন। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে খাদ্যমন্ত্রী দৃষ্টি দেন আন্তর্জাতিক বাজারে। সেখানেও ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হন তিনি। ১০ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্য নিয়ে ভিয়েতনামে গেলেও চুক্তি করতে পেরেছেন মাত্র তিন লাখ টনের। একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে মিয়ানমারেও। ১০ লাখ টন চাল কিনতে চেয়ে আশ্বাস পেয়েছেন তিন লাখ টনের।
সব মিলিয়ে ১৬ লাখ টন ধান, চাল ও গম সংগ্রহের যে ঘোষণা খাদ্যমন্ত্রী দিয়েছিলেন, তার ৭৮ শতাংশই অর্জিত হয়নি। ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও আমদানির মাধ্যমে ধান, চাল ও গম সংগ্রহ করা গেছে চার লাখ টনের কিছু বেশি। যদিও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানের প্রাথমিক সময়সীমা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতার কথা নিজেও স্বীকার করেছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তবে এজন্য তিনি দায়ী করেন বন্যা পরিস্থিতিকে। গত ১৬ আগস্ট সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এবার ১ কোটি ৯১ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, হাওড় ও অন্যান্য এলাকার বন্যায় তা অর্জিত হচ্ছে না। সাত লাখ টন ধান ও আট লাখ টন চাল সংগ্রহের যে পরিকল্পনা করেছিলাম, সেটাও কিনতে পারিনি।
সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতায় টান পড়েছে খাদ্য মজুদেও। সরকারের খাদ্যশস্যের মজুদ অস্বাভাবিক কমে এসেছে। ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাল ও গমের মজুদ ছিল ৪ লাখ ৫৪ হাজার টন; এক বছর আগের একই সময়ে সরকারের কাছে খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল যেখানে ১০ লাখ ৮৭ হাজার টন। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবেই কমছে খাদ্য মজুদ। জানুয়ারি শেষে ৯ লাখ ৪৩ হাজার টন খাদ্যশস্যের মজুদ থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ৯ লাখ ১০ হাজার টনে। মার্চে এ মজুদ আরো কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৬৭ হাজার, এপ্রিলে ৫ লাখ ৬১ হাজার ও মে মাসে ৫ লাখ ৫৩ হাজার টনে। আর জুন শেষে সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদ নেমে আসে ৩ লাখ ৭৮ হাজার টনে।
গত জুলাইয়ে সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আগস্টের মধ্যে দেশে চালের মজুদ ১০ লাখ টনে উন্নীত করা হবে। চাল আমদানির জন্য দরপত্র কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ৪ লাখ ৫০ হাজার চাল পাইপলাইনে রয়েছে। ভারত, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে চাল আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারকের খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজেও নেমে পড়েন খাদ্যমন্ত্রী। ১০ লাখ টন চাল আমদানির উদ্দেশ্যে গত আগস্টে ভিয়েতনামে যান খাদ্যমন্ত্রী। কিন্তু তিন লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করতে সক্ষম হন তিনি। সময়মতো আমদানি করতে না পারায় আগস্টে ১০ লাখ টন চাল মজুদের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাও রক্ষা করতে ব্যর্থ হন খাদ্যমন্ত্রী।
মিয়ানমার থেকেও ১০ লাখ টন চাল কিনতে চেয়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। এজন্য চলতি মাসে দেশটি সফরও করেন তিনি। যদিও তিন লাখ টনের আশ্বাসেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাকে। তিন লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যে মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চলতি মাসেই সমঝোতা স্মারক সই করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
সংকট ও সমস্যার শুরুতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারাটা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বড় ভুল বলে মন্তব্য করেন সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মজুদ শেষ হয়ে এলেও আমদানির পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বিলম্বে। এছাড়া উৎপাদনের বিষয়ে কাগুজে তথ্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সব বিষয় একত্রিত হয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বলা যায়, পরিস্থিতি সামাল দিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে।
উৎপাদন ও মজুদ কমায় চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়িয়ে তা সামাল দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। চাল আমদানির শুল্ক দুই দফায় কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়লেও এর প্রভাব পড়েনি বাজারে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা চালের রফতানি মূল্য বাড়িয়ে দেয়ায় শুল্ক কমানোর সুফল মিলছে না। বাজারে চালের দাম না কমে উল্টো বাড়ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
এর মধ্যেই নতুন সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে ভারত থেকে চাল রফতানি বন্ধের ঘোষণা। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আড়াই মাস বাংলাদেশে চাল রফতানি বন্ধ থাকবে জানিয়ে পেট্রাপোল বন্দরে চিঠি দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগ।