কক্সবাজারের টেকনাফ-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে কুতুপালং, পালংখালী, বালুখালী, থাইংখালী ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের রইক্ষ্যংয়ের পাহাড় এলাকায় রোহিঙ্গাদের কাছে বন বিভাগের মালিকানাধীন সরকারি জমির দখলস্বত্ব বিক্রির হিড়িক পড়েছে। একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ১০ হাত দৈর্ঘ্য ও আট হাত প্রস্থের এক টুকরো জমি ২-৩ হাজার টাকায় তাদের কাছে বিক্রি করছে। এলাকাগুলোয় এরই মধ্যে ১৫ হাজারেরও বেশি অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রভাবশালী এসব দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের মুখপাত্র ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ বলেন, কুতুপালং এলাকার বখতিয়ার মেম্বারসহ স্থানীয় একটি চক্রের বিরুদ্ধে বনের ভূমি বিক্রি করে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের কাছেও এসেছে। তাই এসব প্রভাবশালী কিংবা দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অনেক দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজাও দিয়েছে প্রশাসন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পাশে কুতুপালং এলাকায় কয়েকশ একর ভূমি দখল করে কাঁটাতারসহ বিভিন্নভাবে ঘেরাও দেয়া হয়েছে। এসব ভূমির পাহাড় ও গাছ কেটে বসতি নির্মাণ করতে দখলস্বত্ব বিক্রি করছেন স্থানীয় ইউপি মেম্বার বখতিয়ার আহম্মদ ও নুরুল কবির ভুট্টো। কুতুপালং এলাকায় পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করছেন মিয়ানমারের মংডুর রাইম্যারঘোনা এলাকা থেকে আসা বয়োবৃদ্ধ কামাল আহমদ (৬০) ও তার ছেলে মো. হোসেন (৩০)। মো. হোসেন জানান, এ জমি পেতে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে জমির মালিক দাবিদার স্থানীয় নুরুল কবির ভুট্টো ও বখতিয়ার মেম্বারকে। তাদের ১০ হাত দৈর্ঘ্য ও আট হাত প্রস্থের একটি ঘর নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। টাকা না দিলে কাউকে ঘর তৈরি করতে দেয়া হচ্ছে না।
এরই পাশে আরেকটি বসতি তৈরি করছেন আব্দুল জব্বার নামে আরেক রোহিঙ্গা। তিনি জানান, কুতুপালংয়ে দুদিন রাস্তায় রাত যাপন করে পাশের পাহাড়ে একটা বসতি তৈরি করতে চাইলে বখতিয়ার মেম্বার নামে একজন এসে আমাকে ব্যাপক মারধর করে। পরে তার হাতে ৩ হাজার টাকা তুলে দিলে তিনি বসতি তৈরির অনুমতি দেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি সদস্য বখতিয়ার আহম্মদ বলেন, স্থানীয় কিছু লোক বিপদে ফেলার জন্য সাংবাদিকদের কাছে আমার নাম বলছে। আসলে এসব কাজে আমি কোনোভাবেই জড়িত নই।
একটু দূরে পালংখালী এলাকায় পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের ঘর তৈরির জন্য জমি পরিমাপের কাজ করছিলেন আব্দুল খালেক ও আলী হোসেন। তারা জানান, এ পাহাড়ের মালিক আলী আহম্মদ, আনোয়ার হোসেন, শুক্কুর মেম্বার, মফিদুল আলম, জয়নাল উদ্দিন, হেলাল উদ্দিন মেম্বার, শাহাব উদ্দিন ও নুরুল আলম। তাই তারাই টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের কাছে দখলস্বত্ব বিক্রি করছেন।
একইভাবে এর পাশে তাজনিরমার খোলা এলাকায় পাহাড় কেটে রোহিঙ্গাদের দখলস্বত্ব বিক্রি করছেন নুরুল আমি ও জয়নাল আবেদিন।
টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের রইক্ষ্যংয়ের পাহাড় এলাকার বাসিন্দা শাহাব মিয়া জানান, তাদের ৬০ জনের একটি ভূমিহীন সমিতি রয়েছে। ওই ৬০ জন ভূমি অফিস থেকে জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। প্রত্যেকের সাত কানি করে জমি রয়েছে। তারা সেখানে বিভিন্ন ফসলের আবাদ করতেন। প্রতি বিঘা জমি থেকে মাসে ২ লাখ টাকা আয় হতো। এখন রোহিঙ্গারা আসায় জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গারা ঘর নির্মাণ করছে। তারা এ জমিতে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তাই ক্ষতিপূরণ তুলতেই রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে দেড়-দুই হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ নেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, কুতুপালং থেকে পালংখালী এলাকার মধ্যে দেড় হাজার একর বন ভূমিতে সব রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে যদি কেউ জমি বিক্রির নামে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ বলেন, যেখানে সেখানে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীতে আবাসনের ব্যবস্থা করবে সরকার। এজন্য বন বিভাগের দেড় হাজার একর জমিতে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই ‘সেফ জোনের’ নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১০০ সদস্য মোতায়েন থাকবেন। এছাড়া পুরো এলাকায় বসানো হবে সিসিটিভি। এমনকি বাংলাদেশে আসা নির্যাতিত ও অসুস্থ রোহিঙ্গাদের চিকিৎসায় মেডিকেল টিম গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া বিদেশী কোনো এনজিও রোহিঙ্গাদের সহায়তা করলে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করতে হবে বলে তিনি জানান।