নির্বিচার গুলি। আগুন বোমা। দা-কিরিচের কোপ। পুড়িয়ে দিচ্ছে বসতঘর। মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে মিয়ানমারের রাখাইনের রোহিঙ্গা গ্রামগুলো। প্রাণ বাঁচাতে ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ। ছুটছে এদিক-ওদিক। কিন্তু তাদের পালিয়ে বাঁচার আকুতিও শুনছে না মিয়ানমার সেনা ও পুলিশ সদস্য এবং উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা। পালানোর পথেও যে যেখানে পারছে নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের নির্মমভাবে হত্যা করছে। নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশে আসার সময় নৌকায়ও গুলি চালানো হচ্ছে। নোম্যানস ল্যান্ড বা জিরো পয়েন্টে ঘেরাও করে কোপানো হচ্ছে। করা হচ্ছে জবাই। পথে পথে পড়ছে রোহিঙ্গার লাশ। প্রাণ যাচ্ছে পথে পথে পুঁতে রাখা স্থল মাইনে।
প্রাণ নিয়ে পালানোর পথে এমন নানা নির্মম হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিলেন গতকাল শনিবার নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে আসা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা। তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরে আসা অপর কিছু রোহিঙ্গাও পালানোর পথে মিয়ানমার সেনা এবং উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের কয়েকটি হামলা ঘটনার কথা জানালেন। দেখালেন ক্ষতস্থান। বললেন হারানো স্বজনদের নাম। ভ্যাগের ফেরে নিজেদের বেঁচে ফেরার গল্প।
অনেকে ভাগ্যক্রমে নিজ গ্রামের সহিংসতায় অক্ষত থাকলেও বাংলাদেশের আসার আগ মুহূর্তে পথে প্রাণ হারিয়েছেন। অথচ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতেই তারা দিনের পর দিন হেঁটে আঁকা-বাঁকা বন্ধুর, দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
বুড়িচংয়ের চাংগানা এলাকার টমবাজারের বাসিন্দা মো. ইউনুস। ২৫শে আগস্ট রাতে টমবাজারে তাদের বাড়িতে হামলা চালানো হলে তার চাচাতো ভাই ছাদেক ও অপর আত্মীয় তবারকসহ ৬ জনকে মরতে দেখেন। সেদিন ঘর ছাড়ার ১৪ দিন পর শুক্রবার রাতে তিনি উখিয়ার পালংখালী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন। পালিয়ে আসার পথে ওই ১৪ দিনে তার দলের কয়েক হাজার রোহিঙ্গা দু’বার হামলার শিকার হয়েছে। গতকাল সকালে তার সঙ্গে কথা হয় উখিয়ার আঞ্জুমান বিজিবি ক্যাম্পের কাছে। তিনি বলেন, চাংগানায় ভোরে গুলাগুলির পর দিনে হেলিকপ্টার আসলে টুপি মাথায় দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানের ছদ্মবেশ নিয়ে রাখাইন যুবকরা আমাদের ঘরে আগুন দেয়। পাশের গ্রাম থেকে তা দেখি। খিনিচিসহ বিভিন্ন এলাকায় ৬ দিন কাটানোর পর ফতেয়ার ঢালায় আসি। স্থল মাইনের ভয়ে হাজার হাজার মানুষের দলের আগে আমরা গরুর পাল হাঁটিয়ে আনি। গত ৩১শে আগস্ট আমরা ফতেয়ার ঢালায় পিচ রাস্তা হওয়ার সময় অন্তত ১০টি মোটরসাইকেল নিয়ে সেনা সদস্যরা যাওয়ার সময় গুলি ছোড়ে। এতে টমবাজারের এক যুবকসহ গুলিবিদ্ধ হয়ে ৫জন মারা গেছেন। আরো দুই নারীর গায়ে গুলি লেগেছে। আমরা বসে ও শুয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাই। কয়েকদিন পর গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে আমরা নাফ নদের আগের অপর খালের তীরে আসি। দেখি একদিক থেকে অন্তত ৫০ জন আর্মি ও বৌদ্ধ যুবক আসে। তারা এসেই গুলিবর্ষণ ও কোপানো শুরু করে। এতে শতাধিক লোক মারা গেছে বলে ধারণা তার। এ সময় যে-যেদিকে পেরেছে দৌড়ে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছে। কয়েক হাজার মানুষের দল থেকে কয়েকশ’ লোককে তারা বিচ্ছিন্ন করে তাড়িয়ে একটি ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। পরে সে ঘরে আগুন দিয়ে তাদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে বলে শুনেছি।
ওই ঘটনার সময় সে দলে ছিলেন বুড়িচং থানার তমবাজার এলাকার পোতপ্রাংয়ের বাসিন্দা ইসলামের ছেলে ইলিয়াছ। বয়স ষোলো। সে খাল পার হয়ে নাফের কাছে আসার জন্য তখন নৌকায় উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বর্মিরা এলে ঝাঁপ দিয়ে গলাপানিতে অর্ধডুব দিয়ে প্যারাবনে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে দেখে তাদের বর্বরতা।
তার ভাষায়- ইয়াম্মা খিয়াংডং এলাকার মৌলভী ফয়েজের (৬৫) কোমরে গুলি করে এক সেনা সদস্য। তারপর সে মাথায় কোপ দিয়ে মেরে ফেলে। অপর এক সেনা সদস্য মৌলানা শাকের ওরফে মুফতি সাহেবকে এক বাহুতে কোপ দেয়। এর আগেই তার শিশুপুত্রকে লাথি মেরে কিছুটা দূরে ফেলে দিয়েছিল। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ পর তিনি ওই শিশুকে টেনে তুলার চেষ্টা করলে সেই সেনা সদস্য উল্টো ফিরে এসে তাকে জবাই করে দেয়। তারা দু’জনসহ বেশ কিছু নারী-পুরুষ ও শিশু মারা গেছে বলে জানান তিনি।
গতকাল সকাল ১০টা। উখিয়ার পালংয়ের আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। বুক চিরে এঁকে-বেঁকে গেছে ছোট-বড় আল। সেই পিচ্ছিল আল ও ছোট রাস্তায় মানুষের দীর্ঘ সারি। যত দূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ। পিপিলিকার মতো আসছে তাড়া খাওয়া রোহিঙ্গারা। পালং খাল ও কাছের দীঘির একটু প্রশস্ত তীরজুড়ে অনেকেই দাঁড়িয়ে-বসে আশ্রয় নিচ্ছে। নাফ পেরিয়ে আসা অন্তত ৬ হাজার রোহিঙ্গা হাঁটছিলেন উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়া ও টেকনাফের উলুবুনিয়া লোকালয়ের দিকে। বৃষ্টি ও পিচ্ছল সরু রাস্তায় সেই নারী-শিশু-বৃদ্ধদের বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যরা খেদিয়ে আবার নাফের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন ক্ষুধার্ত-ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত রোহিঙ্গাদের সে কী আকুতি। অনুনয়-বিনয়। কান্না-কাটি। আর্তচিৎকার। মায়ের কোলে ভিজছিল শিশু। নিজের মাকে হারিয়ে অঝর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছিল দশ বছরের এক শিশু। ছমিরন নামে এক বৃদ্ধা কেঁদে কেঁদে বললেন, আমরা বেঁচে থেকে কী লাভ। আমাদের মেরে ফেলো। এমন সময় মিয়ানমারের দিকে প্রথমে দু’টি ও পরে ৫টি শুলির শব্দ শুনা যায়। প্র্রাণে বাঁচার চেষ্টায় পালিয়ে আসার সময় বিপদ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে দাঁড়িয়ে পড়েন কয়েক নারী-যুবক। বলেন, তারা আমাদের প্রাণে বাঁচতে দিচ্ছে না। পালিয়ে আসার পথেই এভাবে গুলি চালানো হচ্ছে।
বেলা ১১টায় পালংখালীর আঞ্জুমান পাড়া দিয়ে বাংলাদেশে আসেন বুচিডং টাউনশিপের মৃত হোছন আলীর পুত্র জয়নুল আবেদীন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তিনি বলেন, শুক্রবার আমরা তুলাতলী-সাহেববাজার হয়ে পুরমার খালের পশ্চিমকূলে আসি। এক রাখাইন যুবক পথ দেখানোর নামে আমাদের কিছু লোককে ডেকে নেয়। কয়েকটি পরিবার তাদের কথা বিশ্বাস করে দলছুট হয়ে খাল পার হয়ে সেখানে গেলে অন্যান্য রাখাইনরা এসে তাদের ঘিরে ফেলে। তাদের আর্তচিৎকার শুনে আমাদের দলের লোকজন ধানক্ষেত দিয়ে দৌড়ে পালায়। এ সময় আমরা ডিয়লতলী এলাকায় ধানক্ষেতে শতাধিক গলাকাটা ও ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখি। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের লাশের পাশে পড়ে আছে জিনিসপত্র। পালিয়ে আসার সময় বর্মি সেনা ও রাখাইন বৌদ্ধরা তাদের গুলি করে ও জবাই করে মেরেছে। সেখানে বহু লাশ দেখার কথা জানালেন আরো অন্তত ১৫ রোহিঙ্গা।
দুপুরের পর বাংলাদেশে আসা তমবাজার এলাকার নারায়নসংয়ের বাসিন্দা সৈয়দ আহমদের পুত্র জাফর উল্লাহ বলেন, এই তো কয়েক ঘণ্টা আগে আমরা ওপারে (মিয়ানমারে) কোয়াংচিবং আসি। আর্মি আসছে পালাও পালাও বলে সামনের লোকদের চিৎকার শুনি। এরপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজন জড়ো হয়ে একত্রিত হই। তখন কয়েকটি গুলির শব্দ শুনা গেছে।
এতেই শেষ নয়। মিয়ানমার সীমান্ত নাফ নদ দিয়ে নৌকায় বাংলাদেশে আসার সময়ও সে দেশের সেনা সদস্যরা স্পিডবোট নিয়ে হামলা চালাচ্ছে। গুলি করছে। করছে কচুকাটা।