মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ থামছে না। তবে এ পর্যন্ত কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই।
কোনো সরকারই তাদের সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করতে পারেনি। গণমাধ্যমসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রমতে, ষাটের দশকের পর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অন্তত ৮ লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। জলপথের পাশাপাশি স্থলপথেও তারা বাংলাদেশে আসে। তবে এ সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি ছাড়িয়ে যাবে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রমতে, ছয় দশক ধরে নির্যাতন ও নির্মূলের মুখে পড়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমার সরকার নতুন করে রোহিঙ্গা নিধন ও উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। গত ২৪ আগস্ট পুনরায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সে দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের সংঘাত শুরু হলে গত ১৬ দিনে ১ লাখ ৭৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক উইংস ইউএনএইচসিআর তথ্য দিয়েছে। এ সংখ্যা অন্তত আড়াই লাখ বলে দাবি করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সর্বমোট ৮ লাখেরও বেশি। সর্বশেষ নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন যারা আসছেন, তাদের কারও পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে। কারও গায়ে আবার পোড়া ক্ষত দেখা যাচ্ছে। গতকালও সীমান্তের ওপার থেকে যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবশে করেছে তাদের মধ্যে শতাধিক নারী-পুরুষের শরীরে এ ধরনের নির্যাতনচিহ্ন দেখা গেছে। কার্যত মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা সে দেশের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর গত ১৬ দিন ধরে যে টানা নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে— তারই হূদয়বিদারক চিত্র তুলে ধরছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। এ বিষয়ে গতকাল পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবক নেয়ামত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের লোকেরা এখন রোহিঙ্গাদের দেখামাত্রই গুলি করে মারছে। আমরা যারা বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর প্রাণ বাঁচাতে স্বজনদের নিয়ে পালিয়ে আসছিলাম তাদেরও পেছন থেকে গুলি ছুড়লে আমরা আহত হই। এ ছাড়া অনেককে বাড়ির ভিতরে আটকে রেখে বাইরে পেট্রল-কেরোসিন ও ছোট ছোট ককটেল বোমা ফাটিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। ’ এই নারকীয় আগুন থেকে ভাগ্যগুণে কেউ কেউ আহত হয়ে বেঁচে যান। তারা পালিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছেন।
অনুপ্রবেশে স্থানীয়দের উদ্বেগ : সরেজমিন দেখা গেছে, স্থল ও নৌসীমান্ত দিয়ে গতকালও অন্তত ৫ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, কক্সবাজারের উখিয়া, রামু ও হ্নীলা, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ সীমান্তবর্তী উপজেলার লোকজনকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। উখিয়ার রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ‘উখিয়া উপজেলায় আমাদের লোকসংখ্যা আছে ৩ লাখের কাছাকাছি। তার ওপর রোহিঙ্গারা আছেন প্রায় ৫ লাখের মতো। এখানে তারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে এখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা ভাবাই যাচ্ছে না। ’
রোগশোকে আক্রান্ত রোহিঙ্গারা : রোহিঙ্গারা টেকনাফ, উখিয়ার ২৫টি পাহাড় ও বনাঞ্চল দখল করে রয়েছেন, সেখানে চলছে মানবেতর জীবনযাপন। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির কিংবা বস্তিগুলোয় দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া, চর্মরোগ, পানিশূন্যতাসহ নানা ব্যাধি। সেইসঙ্গে রয়েছে ওপার থেকে আগুনে পোড়া, গুলিবিদ্ধ ও আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আসা শরণার্থীরাও। শরণার্থী শিবিরগুলোয় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও পানিসংকট। গতকাল সকাল থেকে এখানে অতিমাত্রার বৃষ্টি হওয়ায় শরণার্থীদের জীবন আরও বিপন্ন হয়ে ওঠে। ভেজা স্যাঁতসেঁতে ছোট ছোট খুপরি ঘরে তাদের নাভিশ্বাস ওঠার দশা। বৃষ্টিতে ওপরের পানি ঠেকানো গেলেও খুপরি ঘরের মেজেগুলো ভিজে কদাকার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের অবস্থা এখন বেশি সংকটময় হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানান ‘সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল’ নামে একটি এনজিওর স্থানীয় প্রতিনিধি।
নানামুখী সংকট : গতকালও স্থল ও নৌসীমান্ত দিয়ে অন্তত ৫ হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদেরই বেশি সংকট ও দুর্ভোগের শিকার হতে দেখা গেছে। কারণ, ২৪ আগস্ট মিয়ানমারে সহিংসতা শুরু হলে ২৫ আগস্টের পর থেকে যারা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের অনেকে ইতিমধ্যে ত্রাণ কার্ড পেয়ে গেছেন। কিন্তু দু-তিন দিন ধরে নতুন আসা রোহিঙ্গারা কোনো ত্রাণ কার্ড সংগ্রহ করতে না পারায় তীব্র খাদ্য ও পানি সংকটে ভুগছেন।
চমেক হাসপাতালে ভর্তি ৬৭ : গতকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ৬৭ জন রোহিঙ্গা বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার মধ্যে আটজন রয়েছে বার্ন ইউনিটে। গতকাল মিয়ানমারের মংডু থানায় পৃথক দুটি ঘটনায় আহত তিন শিশুকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন স্বজনরা। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, এই তিন শিশু সেখানে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর আগে এখানে গুলিবিদ্ধ দুজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ছাড়া আরও তিনজন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে যান বলে জানা গেছে।
কক্সবাজারে ৯ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার : কক্সবাজারে নয়জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মাইন উদ্দিন খান জানান, রাতে নাফ নদের সৈকত পয়েন্ট থেকে দুজন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে। সকালে টেকনাফের বাহারছড়া পয়েন্টে আরও ২টি লাশ পাওয়া যায়। উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের জানান, সকালে উখিয়ার মনখালীতে ৩ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে উদ্ধারকৃতদের সবাই নারী ও শিশু। এ ছাড়া টেকনাফের বঙ্গপোসাগরের উপকূলে ও নাফ নদ থেকে দুই রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এনিয়ে গত এক সপ্তাহে কক্সবাজারে অন্তত ৯৫ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ার বালুখালী সীমান্তে মিয়ানমার থেকে মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়ে আসা সাতজনের মৃত্যু হয়েছে।
মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছে : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া গতকাল বিকালে উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা বস্তি পরিদর্শন শেষে বলেন, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশানুযায়ী মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আশ্রিত রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। মিয়ানমারে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।