বন্যায় পানি নেমে গেলেও এখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে দুর্গত এলাকা। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষিজমি-বসতভিটা সর্বত্রই বন্যার ক্ষতচিহ্ন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা রাস্তা বানাই, ভুলে যাই আবার বানাই। কখনো সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা মনে করি না। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট পরিকল্পনামাফিক তৈরি এবং মেরামত করতে হবে। আর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির দিকে নজর দিতে হবে। পৃথিবীর সব দেশে রোড ফান্ড আছে। এখান থেকে রাস্তাঘাট মেরামতের সব খরচ করা হয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, অনেক চেষ্টা করেও আমাদের দেশে রোড ফান্ড গঠন করা যায়নি। এখন যদি রোড ফান্ড সচল থাকত তাহলে বন্যার ক্ষতি খুব সহজেই কাটিয়ে সড়কব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করা যেত। ’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সূত্রমতে, এবারের বন্যায় ৬ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কের ক্ষতি ৪০৩ কিলোমিটার। ২৬৮ সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ ভেঙে গেছে অন্তত ৯৬টি। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন ৪০৩ কিলোমিটার সড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার রাস্তা মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করতে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সে হিসাবে ৪০৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। ক্ষতিগ্রস্ত এই ৩৫০ কিলোমিটার সড়ককে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এলজিইডি নিয়ন্ত্রিত গ্রামীণ সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
দুই দফা বন্যাসহ টানা তিন মাসের বৃষ্টিতে সারা দেশে কমপক্ষে সাড়ে ৬ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতি হওয়া এসব সড়ক-মহাসড়ক মেরামতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক। বিশেষ করে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী মহাসড়কটির প্রায় ৬০ ভাগই ক্ষতির মুখে পড়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর সূত্র জানায়, পরপর দুই দফা বন্যায় সারা দেশে ২ হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে জাতীয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বন্ধ রয়েছে পাঠদান। উত্তরবঙ্গের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয় প্রতি বছরই। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠে পাঠদান বন্ধ হয়ে যায়। পানি সরে গেলে শিক্ষকরা বাড়তি ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অবকাঠামোগত ক্ষতি হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা পেলেই বিভিন্ন ভবন, প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হবে। এ ব্যাপারে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর কাজ করে যাচ্ছে। ’
এবারের দুই দফা বন্যায় পর্যন্ত ৩৩ জেলার ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্বিতীয় দফা বন্যায় ২৭ জেলার ১৩৮ উপজেলা প্লাবিত হয়। এতে প্রায় ১৩ লাখ পরিবারের বন্যাক্রান্ত হয়েছে ৫৭ লাখ ১৮ হাজার মানুষ। বেসরকারি হিসাবমতে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে বন্যায় কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে জানাতে আরও সময় লাগবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রংপুর ও দিনাজপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলায় ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ১৫ হেক্টর জমির আমন খেত নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি ফসলের চাষ করা হয়। এর মধ্যে ৭ হাজার ৫৬৭ হেক্টর জমির শাক-সবজি নষ্ট হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ আলম বলেন, ‘বন্যায় এ অঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলায় ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়। এর মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার ১৫ হেক্টর জমির আমন খেত পানিতে নষ্ট হয়েছে। এ অঞ্চলে ৩ হাজার ৫৬৭ হেক্টর জমির সবজি তলিয়ে যাওয়ায় তা নষ্ট হয়ে গেছে। ’
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদ বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনের কাজ আমরা শুরু করেছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। ’
জানা গেছে, এবারের বন্যায় মত্স্য ও পশুসম্পদ বিভাগের ক্ষতির পরিমাণও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। বন্যায় বিভিন্ন এলাকার দিঘি-পুকুর থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ বেরিয়ে গেছে; যার পরিমাণ আনুমানিক ২ লাখ টন। এ ক্ষতি পোষাতে মাছ চাষিদের প্রণোদনা দিয়ে নতুন করে পোনা ছাড়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে; যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মাছ চাষিরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে আশা করছে মত্স্য অধিদফতর। তবে বন্যায় আশঙ্কার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়েছে গবাদিপশুর ক্ষেত্রে। কিন্তু অনেক জায়গায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ডুবে যাওয়ায় লক্ষাধিক গবাদিপশু পানিতে ভেসে যায়।
বন্যার পানির তোড়ে অনেক স্থানে রেললাইনের নিচের মাটি সরে গিয়ে হয়েছে পুকুরের মতো বড় বড় গর্ত। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। শুধু তাই নয়, রেললাইনের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঈশ্বরদী-ঢাকা রেলপথের টাঙ্গাইল জেলায় রেললাইনের মাটি সরে যাওয়ায় উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী সব ট্রেন বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব ও পশ্চিম রেলস্টেশন পর্যন্ত চলাচল করেছে। যাত্রীদের সেতুর পুবপাড়ে নেমে বাসে ঢাকায় যেতে হয়েছে। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এ ছাড়া অনেক এলাকায় রেললাইনের পাটাতন সরে গেছে। কয়েক শ কিলোমিটার রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। যেগুলো দ্রুত মেরামত করা জরুরি। এতে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনপদগুলোর জন্য যেসব প্রকল্প রয়েছে, সেগুলো পরিকল্পনামাফিক পরিচালনা করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা করতে হবে। কৃষককে বিনামূল্যে বীজ দেওয়া, বসতভিটা ঠিক করতে বরাদ্দ দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষিজমি, রাস্তাঘাটসহ সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে যথাশিগগির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। ’