বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদান নয়, প্রকল্পেই বেশি মনোযোগী শিক্ষকরা

Slider শিক্ষা
পাঠদান নয়, প্রকল্পেই বেশি মনোযোগী শিক্ষকরা

 

জ্ঞান সৃষ্টি ও জ্ঞানের প্রসারে দেশের প্রাচীনতম পাঁচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা কতদূর, তা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন পর্ব-৩

কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) অবদান নতুন নয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) অধীনেই গত তিন দশকে এক হাজারের বেশি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করেছে বাকৃবি। চলমান রয়েছে আরো আড়াইশর বেশি প্রকল্প। এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবেও নানা প্রকল্পে যুক্ত শিক্ষকরা। এসব প্রকল্পে অতি মনোযোগের প্রভাব পড়ছে শ্রেণীকক্ষে। পাঠদানে তুলনামূলক কম সময় দিচ্ছেন শিক্ষকদের কেউ কেউ। যদিও উচ্চশিক্ষায় গবেষণা ও পাঠদান চলার কথা সমানতালে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রণোদনা থাকায় শিক্ষকরা ব্যক্তিগত চেষ্টায় বিভিন্ন ধরনের গবেষণা প্রকল্প আনছেন। একজন শিক্ষক একই সময়ে একাধিক প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছেন। এতে শ্রেণীকক্ষে নিয়ম করে সময় দিতে পারছেন না তারা। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক না পেয়ে ক্লাস না করেই শিক্ষার্থীদের ফিরে যেতে হচ্ছে অনেক সময়।

প্রায়ই এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীদের। কৃষিতত্ত্ব বিভাগের একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাসখানেক আগে নির্ধারিত সময়েই শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত হয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর শিক্ষককে ফোন করলে প্রকল্পের কাজে ব্যস্ত থাকায় ক্লাস নেবেন না বলে জানিয়ে দেন। অথচ ক্লাস না নিলে তা নোটিসের মাধ্যমে জানানোর নিয়ম রয়েছে।

প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠদান থেকে বঞ্চিত করা আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ চর্চা করলে তা বাজে সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়াবে। উচ্চশিক্ষায় গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীদের বিতরণ— একটি অন্যটির পরিপূরক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সব বিভাগেই এ ধরনের সমস্যা কমবেশি আছে। তবে ভেটেরিনারি, কৃষি ও পশুপালন— এ তিন অনুষদের বিভাগগুলোয় সমস্যাটি প্রকট। কৃষি অনুষদের এক শিক্ষার্থী বলেন, উন্নত পাঠদান নিশ্চিত করতে আমাদের বিভাগে প্রত্যেক ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সেকশন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি সেকশনের আলাদা ক্লাস নেয়ার কথা। যদিও আমাদের বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক প্রকল্পের অজুহাতে সব সেকশনের ক্লাস একসঙ্গে নেন। এতে ক্লাসে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অনেক সময় নিজে না এসে জুনিয়র শিক্ষকদেরও পাঠান ক্লাস নিতে।

এ ধরনের সমস্যা থাকলেও তা খুব বেশি মাত্রায় নয় বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সচ্চিদানন্দ দাস চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমি একটি ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলাম। আমার অভিজ্ঞতায়ও এ ধরনের সমস্যা পেয়েছি। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকেও এ ধরনের কিছু অভিযোগ আছে। তবে সেটি খুব বেশি নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ইন্টারঅ্যাকশনের মূল জায়গা শ্রেণীকক্ষ। এর পরও কিছু শিক্ষকের ক্লাসে যেতে শৈথিল্য রয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিভাগীয় প্রধানদের মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এ সমস্যা দূর হতে পারে। শিক্ষকরা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে বলে আমি মনে করি না।

পাঠদানের চেয়ে গবেষণায় শিক্ষকদের মনোযোগ বেশি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গবেষণা প্রকল্প কমছে। যদিও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে বাকৃবির গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। সে বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গবেষণা প্রকল্প ছিল ২৩৮টি। পরের বছর গবেষণায় বরাদ্দ বেড়ে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা হলেও প্রকল্প সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২১০।

গবেষণা প্রকল্প কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতাকে দায়ী করছেন শিক্ষকদের কেউ কেউ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাশেম এ প্রসঙ্গে বলেন, গবেষণা করতে গিয়ে আমি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রপাতি আমাদের এখানে নেই। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য স্যাম্পল নিয়ে ঢাকায় যেতে হয়। এতে অর্থের পাশাপাশি সময়েরও অপচয় হয়।

এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বাকৃবিকে বিশ্বমানে নিয়ে যেতে আরো বেশি অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আকবর। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষি খাতে আজ যে সাফল্য, তার পেছনে নিরলসভাবে কাজ করেছেন বাকৃবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ কৃষক পর্যায়ে তা দ্রুত হস্তান্তর

ও বিস্তারে আমাদের গবেষকরা কাজ করছেন। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কৃষি খাতের উন্নয়নে বাকৃবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তি সেবাও এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি ৫৬ বছরের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়টি। হলগুলোয় ইন্টারনেটের গতি অত্যন্ত ধীর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, অ্যাসাইনমেন্ট ও বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বই ডাউনলোড করা কিংবা ই-মেইল পাঠানোর সময় বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়। এ কাজের জন্য আমাকে শেষ পর্যন্ত মোবাইল কোম্পানির চড়া মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে হয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়কেও প্রতি সেমিস্টারে ১২০ টাকা করে দিতে হচ্ছে।

ময়মনসিংহ শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে ১ হাজার ২৫০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের আওতায় ৪৩টি বিভাগের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ছয়টি অনুষদে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। এসব শিক্ষার্থীকে পাঠদানের জন্য শিক্ষক রয়েছেন ৫৬৯ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক ২৭০ জন, সহযোগী অধ্যাপক ১০৭, সহকারী অধ্যাপক ১৩৯ ও প্রভাষক ৪৬ জন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে আলোচনায় আসে কৃত্রিমভাবে মাছের প্রজনন নিয়ে গবেষণার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে ধান কাটার যন্ত্র বা থ্রেশার মেশিন ও আগাছা নিধন যন্ত্র উদ্ভাবন করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এছাড়া বিভিন্ন জাতের ফল ও মাছের জাত উদ্ভাবন নিয়েও গবেষণা হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ নিয়ে। সব মিলিয়ে দেশের কৃষিভিত্তিক উচ্চশিক্ষার নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *