মিয়ানমার থেকে নৌপথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে বুধবার ভোরে রোহিঙ্গা শরণার্থী বহনকারী ১১টি নৌকা ডুবে গেছে। বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদীর মোহনায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এরপর উদ্ধার অভিযান শুরু হলে বেলা দেড়টা পর্যন্ত শিশুসহ আট রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়।নৌকাডুবির ঘটনায় আরও অন্তত অর্ধ-শতাধিক রোহিঙ্গা নিখোঁজ রয়েছে বলে জানান তাদের স্বজনরা।
অপরদিকে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। গত ১৩ দিনে সোয়া লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে এর সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফজলুল হক জানান, টেকনাফের বদরমোকাম এলাকার উপকূলে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। নৌকাডুবির পর অনেকে সাঁতরে তীরে উঠেছেন। এখান থেকে পাঁচটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া আরও তিনটি পুরনো অর্ধগলিত লাশসহ মোট আটটি লাশ উদ্ধার করা হয়।
জানা গেছে, নৌকাডুবির এই ঘটনায় শতাধিক রোহিঙ্গা এখনো নিখোঁজ রয়েছে। নাফ নদীর মোহনা অতিক্রম করার সময় নৌকা উল্টে যায়, আর একেকটি নৌকায় ২৫ থেকে ৩০ জন যাত্রী ছিল, যা ধারণ ক্ষমতার বেশি ছিল।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাঈনুদ্দিন খান জানান, স্থানীয়দের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের ১১টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি। ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। এ পর্যন্ত আটজন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারে নির্বিচারে হত্যা ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ায় প্রাণ বাঁচাতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা এখনো সীমান্ত দিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা এই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের স্রোত এখন সীমান্ত এলাকা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজার, বান্দরবান এবং চট্টগ্রাম জেলার গ্রামগঞ্জে। তবে অধিকাংশ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীর ১২-১৫টি পাহাড়ে তাবু ও বাঁশ-পলিথিনের কুঁড়ঘর নির্মাণ করে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।
বুধবার দিনভর এসব পাহাড়ে ছোট ছোট ঘর তৈরি করে রোহিঙ্গাদের নতুন ঠিকানা গড়ে নিতে দেখা গেছে। এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও সংখ্যাটি ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার বলছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র। আর জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) গতকাল এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, গত মাস থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
অন্যদিকে, মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অন্তত ৪০টি সীমান্তপথ দিয়ে আরও অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ টেকনাফের ল্যাদা, মুছনী ও উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালীসহ বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিলেও অনেকে গ্রামগঞ্জে ঢুকে পড়ছে।
টেকনাফের নাইট্যংপাড়া, কেরুনতলি, হ্নীলার দমদমিয়া, জাদিমোরা, ল্যাদা, আলীখালী, হোয়াইক্যং মিনাবাজার, কানজরপাড়া, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম, জলপাইতলী, তমব্রু, আজোহাইয়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির আঙিনায় দিশেহারা রোহিঙ্গাদেও আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।
সীমান্ত পার হওয়ার সময় গত কয়েকদিন তাদের তেমন কোনো বাধার মুখে পড়তে দেখা যায়নি। টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বসে থাকতে দেখা গেছে। কেউ কেউ গাড়িতে উঠে কক্সবাজারের দিকে চলে যাচ্ছে। সমুদ্র উপকূলের ‘কক্সবাজার-টেকনাফ’ মেরিন ড্রাইভ সড়কেও একই অবস্থা। রোহিঙ্গারা ইজিবাইক, জিপ ও অটোরিকশায় করে উখিয়া ও কক্সবাজারের দিকে ছুটছে।
সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বালুখালী পাহাড়ের ৫০ একর জায়গা ছেড়ে দেওয়া হলে অনেকেই সেখানে তাদের আশ্রয়স্থল তৈরি শুরু করে দিয়েছে। একইসঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ বসবাস শুরু করলে তাদেরও আটক করা হবে বলে জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। তাই টেকনাফ ও উখিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ‘রোহিঙ্গা শিবিরে’ পৌঁছে দেওয়ার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
রাখাইন রাজ্যে এখনও গুলির শব্দ ও আগুনের শিখা:
মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে গতকাল সকাল থেকে দফায় দফায় গুলির শব্দ ভেসে আসছিল। এছাড়া রোহিঙ্গা পাড়া জ্বালিয়ে দেওয়ায় বেশ কয়েকটি স্থানে আগুনের শিখা ও ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসা শুরু হলেও থামছে রোহিঙ্গা নির্যাতন। মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের উপর তাদেরও অত্যাচার নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে বলে জানা গেছে।
অনুপ্রবেশকালে আড়াই হাজার রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক:
গতকাল সাগরপথ ও স্থল সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশকালে প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করেছে বিজিবি।
টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম জানান, গতকাল অনুপ্রবেশের সময় দুই হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে প্রতিরোধ করা হয়েছে এবং তাদের পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু রাতের আঁধারে তারা ঢুকে পড়ছে বলেও জানান তিনি।
শাহপরীর দ্বীপে হাজার হাজার রোহিঙ্গা:
গতকাল টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বেড়িবাঁধের ওপর দেখা গেছে। নৌকায় নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গাদের চোখে-মুখে অনাহার ও আতঙ্কেও ছাপ লক্ষ্য করা গেছে।
শাহপরীর দ্বীপ ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, গতকাল এক দিনেই শাহপরীর দ্বীপে ঢুকেছে প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা। মানবিক কারণে তাদের কেউ আর বাধা দিচ্ছে না। শাহপরীর দ্বীপ ছাড়াও খুরেরমুখ, সাবরাং, মহেশখালীয়াপাড়া, নাইটংপাড়া, বাহারছড়া, বড়ডেইল, শাপলাপুর উপকূল দিয়ে ঢুকেছে এসব রোহিঙ্গা।
জানা গেছে, নৌকা দিয়ে রোহিঙ্গা পারাপার বন্ধ করতে গতকাল সাবরাং, টেকনাফ ও বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে জেলে ও নৌকার মালিকদের নিয়ে পৃথক তিনটি সভা করেছে উপজেলা প্রশাসন। এসময় নৌকার মালিক ও জেলেদের রোহিঙ্গা পারাপার বন্ধ রাখতে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা ও সর্তক করা হয়।
চমেক হাসপাতালে ভর্তি ৪৯ রোহিঙ্গা:
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ণ ইউনিট, ক্যাজুয়ালিটি ও বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৪৯ জন নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থী। এ পর্যন্ত মোট ৫৪ জন রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে ভর্তি হলেও ইতিমধ্যে গুলিবিদ্ধ দুই জন মারা যান এবং আরও তিনজন চিকিৎসা নিয়ে চলে যান বলে জানিয়েছে চমেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম। এছাড়া টেকনাফ, কক্সবাজার ও উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।