বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে স্থলবোমা বা ল্যান্ডমাইন পেতে রেখেছে মিয়ানমার। তিন দিন ধরে এমনটা করা হয়েছে। ঢাকায় সরকারি দুটি সূত্র এ কথা বলেছেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ওই দুটি সূত্র। তবে তারা তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে নারাজ। তারা বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হলো- পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মুসলিমরা যাতে আর মিয়ানমারে ফিরে যেতে না পারেন। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। আজ বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রতিবাদ জানানোর কথা বাংলাদেশের। গত ২৫ শে আগস্ট রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিরা মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনা চৌকিতে হামলা চালায়। এর ফলে সেনাবাহিনী প্রতিশোধমুলক হামলা শুরু করে। ওই দিনই এতে মোট নিহত হন ৮৯ জন। এর মধ্যে ১১ জন পুলিশ বা সেনা কর্মকর্তা। বাকিরা রোহিঙ্গা। তবে তারা সবাই হামলার দায় স্বীকার করা আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি’র সদস্য কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় নি। ওই ঘটনার পর সেনাবাহিনী সাধারণ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করেছে। গণহারে ধর্ষণ করছে নারী, টিনেজ বালিকাদের। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না তারা। ধর্ষণ শেষে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় মেরে ফেলছে। কখনো গলা কেটে ফেলছে। কেটে ফেলছে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। শিশুদের হত্যা করছে অবর্ণনীয় নির্যাতনের মাধ্যমে। গুলি করে হত্যা করছে মানুষ। পুড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এসব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থাগুলো, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র গবেষক তেজ¯্রী থাপা এক লেখায় এর সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নাফ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন রাখাইন জ্বলছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীই স্বীকার করেছে তারা কমপক্ষে ৪০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। বাস্তবে এ সংখ্যা কত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ গোঁড়া জাতীয়তাবাদীরা মিলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর এমন নির্যাতনের ফলে কমপক্ষে এক লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে বড় ধরণের মানবিক সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের ওই দুই সূত্র বলেছেন, বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে সীমান্ত পিলারের মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে তারা (মিয়ানমার) তাদের এলাকায় কাঁটা তারের বেড়ার পাশেই পুঁতে রেখেছে স্থলমাইল। ফটোগ্রাফিক ও তথ্য সরবরাহকারীদের মাধ্যমে এ বিষয়টি বাংলাদেশ জানতে পেরেছে বলে জানান তারা। এক সূত্র বলেন, আমাদের বাহিনী দেখতে পেয়েছে কাঁটা তারের বেড়ার কাছেই তিন থেকে চারটি গ্রুপ মাটিতে কিছু পুঁতে রাখছে। এরপর আমাদের ইনফরমারদের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, তারা স্থলমাইন পুঁতে রাখছিল। তবে ওই গ্রুপের সদস্যরা সেনাবাহিনী বা কোনো বাহিনীর নির্ধারিত পোশাক পরা ছিলেন কিনা তা স্পষ্ট করেন নি ওই দুই সূত্রের কেউই। তবে তারা এটা বলেছেন, ওই লোকগুলো রোহিঙ্গা উগ্রপন্থি ছিল না। এর আগে বার্তা সংস্থাকে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের একজন কর্মকর্তা মনজুরুল হাসান খান বলেছিলেন, সোমবার খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, মিয়ানমারের বিভিন্ন বাহিনী সীমান্তে স্থল বোমা বা ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখছে। এর পর মঙ্গলবার তারা মিয়ানমার অংশে দুটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। মঙ্গলবার এ সময় সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছিল একটি বালক। ওই বিস্ফোরণে তার বাম পা উড়ে গেছে। এরপর তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছে চিকিৎসার জন্য। আরেকটি বালক অল্প আহত হয়েছে। মনজুরুল হাসান খান বলেন, এটি হয়তো মাইন বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্তে নো ম্যানস ল্যান্ডে যেখানে আটকা পড়েছেন অনেক রোহিঙ্গা সেখানকার একটি পায়ে হাঁটার পথে একজন রোহিঙ্গা হাঁটছিলেন। তিনি এ সময় বিস্ফোরণ স্থলের ছবি ধারণ করেছিলেন। সেটা দৃশ্যত একটি মাইন হতে পারে। দেখা গেছে প্রায় ১০ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি ধাতব ডিস্ক মাটির ভিতর আংশিক পুঁতে রাখা হয়েছে। ওই রোহিঙ্গা বলেছেন, তিনি আরো দুটি একই রকম ডিভাইস মাটিতে পোঁতা দেখতে পেয়েছেন। দু’জন রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেছেন, ওই বিস্ফোরণের আগে সোমবার ঘটনাস্থলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখতে পেয়েছিলেন। তবে সীমান্তে বিস্ফোরণের বিষয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোনো মন্তব্য করে নি। স্টেট কাউন্সেল অং সান সুচির মুখপাত্র জাও হতাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তাকে পাওয়া যায় নি। সোমবার তিনি বলেছিলেন, কোথায় বিস্ফোরণ হয়েছে, কারা সেখানে গিয়েছিল এবং কারা সেখানে ল্যান্ডমাইন পুঁতে রেখেছে তা নিশ্চিত হতে হবে। তিনি এ সময় আরো বলেছিলেনÑ কে নিশ্চিত করে বলতে পারে ওইসব ল্যান্ড মাইন সন্ত্রাসীরা ( রোহিঙ্গা) পোতে নি?
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিনও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হন নি। উল্লেখ্য, ঢাকাভিত্তিক সূত্রগুলো যে পিলারের মাঝে ল্যান্ডমাইন পেতে রাখার কথা বলেছেন, সেইসব পিলার মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সীমানাকে আলাদা করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রয়েছে কাঁটা তারের বেড়া। এ দুটি দেশের মধ্যে রয়েছে ২১৭ কিলোমিটার ফাঁকফোকরযুক্ত সীমান্ত। একটি সূত্র বলেছেন, তারা (মিয়ানমার) বাংলাদেশের মাটিতে কিছুই করছে না। তবে এর আগে কখনো আমরা সীমান্তে এভাবে স্থল বোমা পেতে রাখতে দেখি নি। কয়েক বছর আগেও মিয়ানমার ছিল সেনা শাসনের অধীনে। বিশ্বে যেসব দেশের হাতে সবচেয়ে বেশি স্থল বোমা বা ল্যান্ডমাইন আছে তার অন্যতম মিয়ানমার। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের ল্যান্ড মাইন নিষিদ্ধ বিষয়ক চুক্তি ‘১৯৯৭ ইউএন মাইন ব্যান ট্রিটি’তে যে কয়েকটি দেশ স্বাক্ষর করে নি, তার মধ্যে মিয়ানমার একটি।