মিনা বেগমের বাড়ি জামালপুরের একটি গ্রামে। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ‘বুয়ার’ কাজ করে জীবিকা চলে তাঁর। ঢাকায় স্বামীসহ আছেন ঠিকই, মেয়ে দুটি থাকে গ্রামে, নানির কাছে। উৎসব বা বিশেষ দিন এলে মেয়েরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকে—কখন আসবেন মা-বাবা। ঈদুল ফিতরে মিনা যাও বা গ্রামে গিয়েছিলেন, এবার আর যাওয়া হয়নি। বললেন, ‘আমগোর তো কুরবানি দেওয়ার ক্ষেমতা নাই। বাড়িত গেলে মাইয়ারা মাংসের লাইগা চাইয়া থাকব। এক টুকরা মাংসের লাইগা রইয়া গেলাম!’
মিনা জানালেন, যেসব বাসাবাড়িতে কাজ করেন, এর মধ্যে অর্ধেক বাসার মানুষই গ্রামে চলে গেছেন। যাঁরা আছেন, তাঁদের কাছ থেকে কম মাংস ওঠেনি। কেজি দশেক তো হবেই। এই মাংস হলুদ দিয়ে জ্বাল দিয়ে রেখেছেন। আজ রোববার ভোরেই তাঁর এই মাংস নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা। তাঁর চোখেমুখে বাড়ি ফেরার ব্যাকুলতা। বাড়ি ফিরবেন, হাঁড়ি ভরে মাংস রান্না হবে, মেয়েরা মন ভরে মাংস খাবে—এই সুখকল্পনায় মিনার মুখখানি উজ্জ্বল। এমন অনেক মিনা রয়েছেন নগরজুড়ে, বছরের একটি দিনকে ঘিরে যাঁদের ‘এক টুকরা মাংসের’ প্রত্যাশা সযত্নে লালিত হয়।
সাইদুল মাংস কাটাকুটি করেন। পেশাদার নন, মৌসুমি। বিশেষ করে ঈদুল আজহার সময়। নিজের পশু কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। অন্যের কোরবানি দেওয়া পশুর মাংস কেটে দু-পয়সা পেয়ে থাকেন। কোরবানির ঈদ এলেই তিন-চার দিন আগে ঢাকায় চলে আসেন। এ সময় সাইদুলের মতো মানুষের খুব চাহিদা। পেশাদার মাংস কাটার লোকজন সকালের প্রথম দফায় গরুর মাংস কাটতে হাজারে যেখানে ২০০ টাকা নিয়ে থাকেন, সাইদুল সেখানে ১০০ টাকা পেলেই খুশি। কাজটা অবশ্য একা করেন না। সঙ্গে দুজন সঙ্গীও আছে। তাঁদের সঙ্গে থাকে চাপাতিসহ মাংস কাটার ধারলো অস্ত্র। তাঁরও ইচ্ছা থাকে নগদ কিছু টাকা আর মাংস নিয়ে গ্রামে ফেরার। আদরের সন্তানদের মুখে মাংস তুলে দেওয়া।
সাইদুলের বাড়ি কিশোরগঞ্জর নিকলী। তিনি বলেন, ‘গেরামে মাংস তো তেমন পাওয়া যায় না। আর কাটাকুটি করলে কেউ পয়সাও দিতে চায় না। ওই মাংস দিয়াই উশুল। তাই ঢাকায় আসি।’
সাইদুল জানালেন, গত বছর কোরবানির ঈদে কাজ করে কেবল টাকাই পেয়েছন। কোরবানিদাতা মাংস দেননি। তাই এবার ঠিকানা বদল করেছেন।
কোরবানির মাংস পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষী মানুষের আরেকটি দল হচ্ছে ছিন্নমূল ভবঘুরে মানুষ। নগরে যাঁদের নির্দিষ্ট ঠাঁই-ঠিকানা নেই। যেখানে রাত, সেখানেই কাত। এই দলের একজন জমিলা। মাঝবয়সী এই নারী জানালেন, বাড়ি বাড়ি এক টুকরা করে নিয়ে ভালোই জোটে। তা চার-পাঁচ কেজি তো হয়ই। কিন্তু রেঁধে খাওয়ার মতো সামর্থ্য তো নেই। তিনি বলেন, ‘ও, বাবা, রাইন্দা যে খামু, হাঁইসাল পামু কোনে? থাকনের জায়গাই তো নাই!’
তাহলে এই মাংস দিয়ে কী করেন তিনি?
সহজ উত্তর, ‘কী আর করমু, বাবা? বেইচ্চা হালাই!’
কারা কেনে?
জমিলা বলেন, ‘যাগোর মাংস খাওয়ার ইচ্ছা আছে, চাইতে শরম পায়, হেরাই বেশি কেনে!’
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]