সীমিত ওভারের ক্রিকেটে প্রতিপক্ষের সমীহটা আগেই আদায় করেছে বাংলাদেশ। বাকি ছিল টেস্ট ক্রিকেট। দেশের মাটিতে প্রথমে ইংল্যান্ড এবং সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে মুশফিকরা জানিয়ে দিলেন, তারাও তৈরি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঠিক যেমনটা দেখিয়েছিল অর্জুনা রানাতুঙ্গার শ্রীলংকা। এ কথা ঠিক যে, অরবিন্দ ডি সিলভা, সনত্ জয়সুরিয়া ও মুত্তিয়া মুরালিধরনের মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটার পেয়েছিলেন রানাতুঙ্গা। বাংলাদেশেও রয়েছে সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমের মতো ক্রিকেটার, যারা আবার একসঙ্গে খেলছেন অনেক দিন ধরে।
টেস্ট ক্রিকেটে মুশফিকরা সবচেয়ে বড় দাগটা কেটেছেন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে। এর মধ্য দিয়ে ডুবেছে অহঙ্কারের টাইটানিকটাও। ১৪ বছর পেছনে যাওয়া যাক। ২০০৩ সালের জুলাই। প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া সফরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ডেভিড হুকস নামে অখ্যাত ক্রিকেটারের একটি মন্তব্য পারমাণবিক বোমার মতো বিস্ফোরণ ঘটাল বিশ্বক্রিকেটে। ক্রিকেটে সর্বকালের সফলতম অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া তখন বলে-কয়ে হারাচ্ছে সব দলকে। প্রবল পরাক্রম অস্ট্রেলিয়ার সামনে বাংলাদেশ। এ যেন বাঘের সামনে ছাগশিশু! ঠিক এ রকম একটা সময়ে বাংলাদেশকে একদিনের মধ্যে টেস্ট হারিয়ে দেয়ার আহ্বান জানালেন হুকস।
‘একদিনে টেস্ট হারাও’— এটা হয়ে গেল স্লোগানের মতো। ওই সফরে দুটি টেস্টেই হেরেছে বাংলাদেশ। প্রত্যাশিত ফল। প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ হেরেছে তৃতীয় দিনে। আর দ্বিতীয় টেস্টের হার চতুর্থ দিনে। এমন আপত্তিকর কথার চাবুক হজম করে লড়াইয়ের ব্যাটনটা আগামীর জন্য পরম যত্ন করে তুলে রাখেন মোহাম্মদ রফিক, হাবিবুল বাশার, মাশরাফি মর্তুজারা। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বন্ধুর পথে বাংলাদেশের উন্নতির গ্রাফটা থেকেছে ঊর্ধ্বমুখী। অস্ট্রেলিয়ার সেই প্রতাপও ফিকে হয়ে এসেছে অনেকটাই। তবে আভিজাত্যের অহঙ্কার ছাড়েনি দলটিকে। উঁচু নাক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের উত্তরাধিকার সম্পত্তি! এটা অনুধাবন করার জন্য বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। দুই বছর ধরে বাংলাদেশ সফর নিয়ে তাদের আচরণগুলোই বলে দেয় সবকিছু।
অংকের হিসাবে ১১ বছর পর বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো টেস্ট সিরিজ খেলছে অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট স্ট্যাটাস-সমৃদ্ধ একটা দলের সঙ্গে প্রায় এক যুগ পর আরেকটা দল টেস্ট খেলবে? কোনো জবাব নেই। কেননা দলটি যে অস্ট্রেলিয়া! অনেক সাধ্যি-সাধনার পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরে সম্মত হলো দেশটি। কিন্তু নির্ধারিত সফর হলো না। এবারের অস্ট্রেলিয়ার অজুহাত নিরাপত্তা। কি অদ্ভুত যুক্তি! খেলার মান যা-ই হোক, নিরাপদ আয়োজনে বাংলাদেশকে টেক্কা দিতে পারে, এমন দেশ কয়টা আছে? একের পর এক এশিয়া কাপ আয়োজন, ওয়ানডে বিশ্বকাপ কিংবা এককভাবে টি২০ বিশ্বকাপ আয়োজন হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত, নির্বিঘ্ন। শুধু ক্রিকেট কেন, গেমস কিংবা ফুটবল টুর্নামেন্ট সবকিছুর আয়োজনই হয়েছে নিয়মিত।
ঢাকায় খেলে গেছেন ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি। অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ সফর স্থগিত করার সময়টাতেও নিয়মিতভাবেই বসেছে আন্তর্জাতিক আসর। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচ খেলেছে অস্ট্রেলিয়া ফুটবল দলও। কিন্তু কোনো কিছুই ধর্তব্যের মধ্যে নেয়নি তারা। বাংলাদেশ সফরে না আসার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে গর্ব-আভিজাত্যে অন্ধ ক্রিকেটের অস্ট্রেলিয়া। অনেক টালবাহানার পর অবশেষে বাংলাদেশ সফরে এল অস্ট্রেলিয়া। তবে সেই পুরনো মেজাজ (!) কিন্তু ঠিকই দেখিয়েছে স্টিভেন স্মিথের দলটি। প্রতিপক্ষকে কথার ঘায়ে জব্দ করাটা এখন স্পোর্টসের ঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ। সিরিজ সামনে রেখে বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেন, ‘আমাদের ২-০ ব্যবধানেও জেতা সম্ভব।’ একই সুরে কণ্ঠ মেলালেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমরাও। কোনো সিরিজ শুরুর আগে এমন কথা বলাটা তো খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এই স্বাভাবিক ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেন না অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্মিথ।
বাংলাদেশের ২-০ ব্যবধানে জিততে চাওয়ার মধ্যে ‘অন্যায়’ খুঁজে পেলেন স্মিথ। মিরপুর টেস্ট সামনে রেখে সংবাদ সম্মেলনে স্মিথ জানালেন, ‘স্বাগতিকদের ২-০ ব্যবধানে জিততে চাওয়ার কথায় আমি খুবই বিস্মিত। যতদূর জানি, ১০০ টেস্ট খেলে বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র নয় টেস্টে।’ স্বাগতিকরা অতি আত্মবিশ্বাসী, এমনটাও বলতে ছাড়েননি স্মিথ। অসি দলপতির কথা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মাঠে জয়ের জন্য খেলতে নামাটাই যেন বাংলাদেশের একটা অপরাধ! দিনকে দিন বাংলাদেশ বড়দের সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে আনছে, প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে বাংলাদেশ, এসব কিছুর চেয়ে বাংলাদেশের অতীত নিয়ে টানাটানি করলেন সফরকারী অধিনায়ক।
সব মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে উপেক্ষার জবাব দেয়াটা হয়ে উঠেছিল সময়ের দাবি। ১৬ কোটি মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করলেন সাকিবরা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় শুধু জয় নয়, জয়ের চেয়েও বেশি উপেক্ষার জবাব। জেতার পর স্বভাবতই উঠল ২-০ ব্যবধানে জয়ের কথাও। প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া নামের ক্রিকেট ‘টাইটানিক’ ডোবানোর পরও পা কিন্তু মাটিতেই রেখেছে বাংলাদেশ শিবির। জয়ের সম্ভাবনার বেশি বলতে চাননি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। তার ভাষায়, ‘সিরিজে আমরাও ২-০ ব্যবধানে জিততে পারতাম আবার ২-০ ব্যবধানে জিততে পারত অস্ট্রেলিয়াও। যেহেতু এখন আর ওদের ২-০ ব্যবধানে জেতার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমাদের এটা সম্ভব বলেই মনে করছি।’