বিশ্বকাঁপানো রোমাঞ্চকর জয়

Slider খেলা
বিশ্বকাঁপানো রোমাঞ্চকর জয়

জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কার পর অস্ট্রেলিয়া। চট্টগ্রাম, কিংস্টোন, সেন্ট জর্জেস, মিরপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম, কলম্বো হয়ে ফের মিরপুর।
সব জায়গায় পতপত করে উড়েছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। দেশ ও ভেন্যুগুলোর নাম এখন এ দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সোনালি অংশ। আনন্দের সাত রঙে সাজানো উৎসবের মুহূর্তগুলো জড়িয়ে আছে এসব নামের সঙ্গে। মিরপুরে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ শুধু বিশ্বকাঁপানো রোমাঞ্চকর জয়ই পায়নি, অনেকের অনেক প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছে। জবাব দিয়েছে অনেক সমালোচনার। ২০ রানের অবিশ্বাস্য জয়ের নায়ক সাকিব আল হাসান, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমরা জ্বলজ্বল করবেন বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে হাজার বছর। ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ডের দেশটির ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী হতে, ক্রিকেটারদের উৎসাহ দিতে শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও মাঠে উপস্থিন হন ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিঠের ব্যথায় দেশে উড়ে যাওয়ার কথা ছিল জশ হ্যাজলওডের। ম্যাচের পরিস্থিতি তাকে বিমানে চড়তে দেয়নি। বরং কোমরে ইনজেকশন নিয়ে মাঠে নামতে বাধ্য হন। তাতে অবশ্য কোনো লাভ হয়নি অস্ট্রেলিয়ার। দুরন্ত বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি সফরকারীরা। পেরে ওঠেননি দুর্ধর্ষ বাংলাদেশের সঙ্গে। জাদুকর সাকিবের অবিশ্বাস্য বোলিং, মিরাজ ও তাইজুলের জাদুকরী স্পিন এবং তামিমের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে মিরপুরে চোখ-ধাঁধানো, অবিশ্বাস্য জয় তুলে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসকে আরও বর্ণময়, আরও জমকালো করল বাংলাদেশ।

টেস্ট ক্রিকেটের পরতে পরতে যে উত্তেজনা ও রোমাঞ্চ ছড়ানো থাকে মিরপুর তার সর্বশেষ উদাহরণ। মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে হেডিংলিতে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য জয় তুলে ক্রিকেট ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হেডিংলির জয়টিকে বলা হচ্ছে টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা। মিরপুরে স্টিভ স্মিথদের বিপক্ষে মুশফিকদের জয়ও কিন্তু তার চেয়ে কম রোমাঞ্চিত নয়। একসময় তিন, সাড়ে তিন দিনে হেরে যেত বাংলাদেশ। এখন সেই বাংলাদেশই বলে কয়ে হারাচ্ছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলোকে। হারের কালিমা লেপে দিচ্ছে তিন, সাড়ে তিন দিনে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! ওয়ানডের পর টেস্ট ক্রিকেটে এখন ক্রিকেট পরাশক্তির খাতায় নাম লেখানোর পথে হাঁটছেন টাইগাররা।

ইতিহাস অস্ট্রেলিয়ার কথা বলেনি। হেলে পড়েছে বাংলাদেশের দিকে। উপমহাদেশের মাটিতে ২০০-এর ওপর রান তাড়া করে অস্ট্রেলিয়ার জয় সাকল্যে সাতটি। তাও ১১ বছর আগে ফতুল্লায়। ২০০৬ সালে রিকি পন্টিং ও অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সেঞ্চুরি এবং স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের ঘূর্ণিতে ৩০৭ রান তাড়া করে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। এরপর চতুর্থ ইনিংস তাড়া করে ম্যাচ জিতেছে আরও ছয়টি। কিন্তু সেসব ২০০-এর নিচে। তাই ২৬৫ রান নিয়ে জয়ের আত্মবিশ্বাস থাকাই স্বাভাবিক মুশফিকদের। সেই আত্মবিশ্বাস পুঞ্জীভূত শক্তিতে পরিণত করে দিনের চার সেশন হাতে রেখে জয় তুলে নেয়। যদিও স্মিথ ও ওয়ার্নার আগের রাতে ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন মুশফিকদের। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে গতকালও অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করেন দুই অসি ব্যাটসম্যান। আগের দিনের সঙ্গে যোগ করেন আরও ৫০ রান। এরপর হঠাৎ করেই ছন্দপতন। সাকিবের আর্ম বলে ফরোয়ার্ড খেলে বোকা বনে যান ওয়ার্নার। আম্পায়ার আলিমদার লেগ বিফোর দেওয়ার পর রিভিউ চান ওয়ার্নার। কিন্তু টিভি আম্পায়ার পরিষ্কার জানিয়ে দেন আলিমদার ঠিক। এরপর আর দাঁড়াননি ওয়ার্নার। ১১২ রানে মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়েন অস্ট্রেলিয়ার ভাগ্যটাও সঙ্গী করে। ওয়ার্নারের বিদায়ের অল্প কিছু সময় পর অধিনায়ক স্মিথকে ফেরত পাঠান সাকিব। চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়ানো দুই ক্রিকেটারকে সাজঘরে ফেরত পাঠানোর পরই নির্ধারিত হয়ে যায় বাংলাদেশের জয়। শুধু সময়সাপেক্ষ। এর পর থেকেই ক্ষণ গুনতে থাকে গোটা বাংলাদেশ। গত অক্টোবরে এমনই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ২৭৩ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে বিনা উইকেটে ১০০ রান তুলে ফেলেছিল ইংল্যান্ড। এর পরই মিরাজ ও সাকিব দুই প্রান্ত দিয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে ১৬৪ রানে গুটিয়ে দিয়েছিলেন ইংরেজদের। বাংলাদেশ জয় পেয়েছিল ১০৮ রানের। গত বছরের ওই জয়ের কথা মনে রেখেই আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে জয়ের কথা বলেছিলেন তামিম। সেই কথা রাখতেই যেন মরিয়া হয়ে ওঠেন সাকিব, মিরাজ ও তাইজুল। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ড ব্যাট করেছে ৭০.৫ ওভার। তাতে পেসার মুস্তাফিজুর রহমান বোলিং করেছেন ১টি। বাকি ৬৯.৫ ওভারই করেছেন স্পিনাররা। তাতেই বাজিমাত। ইংল্যান্ডের পর অস্ট্রেলিয়াকে স্পিন ঘূর্ণিতেই কুপোকাত!

প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ২৬০ রান করেছিল সাকিব ও তামিমের জোড়া হাফ সেঞ্চুরিতে। সফরকারীদের ২১৭ রানে বেঁধে ফেলেছিলেন সাকিব ৫ উইকেট নিয়ে। ক্যারিয়ারের ৫০ নম্বর টেস্টটি স্মরণীয় করে রাখতে এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! ব্যাট হাতে ৭৮ এবং বোলিংয়ে ৫ উইকেট! এর পরও কিছু বাকি ছিল জাদুকর সাকিবের। দ্বিতীয় ইনিংসে ভালো ব্যাটিং না করলেও বোলিং স্মরণীয় করে রাখেন।

দেশের ১০১ নম্বর টেস্টে ১০ নম্বর জয় তুলে দিতে ফের ৫ উইকেট নেন সাকিব। সব মিলিয়ে দুই ইনিংসে ১০ উইকেট; যা তার ৫০ টেস্ট ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বার। প্রথমবার নিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে সাকিবই প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে দুবার ১০ উইকেট নিয়েছেন। জাদুকরী সাকিবের যোগ্য সতীর্থ হিসেবে অসিদের ডানা কেটে দিয়েছেন অফ স্পিনার মিরাজ ও বাঁ হাতি স্পিনার তাইজুল। প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট নেওয়া মিরাজ দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছেন ২ উইকেট। স্মিথবাহিনীর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া তাইজুল নেন ৩ উইকেট। জশ হ্যাজলওডের উইকেটটি নিয়ে আনন্দে আত্মহারা তাইজুল যেভাবে দুই হাত দুই দিকে মেলে ধরেন, তা তো গোটা দেশের আনন্দ-উচ্ছ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ।

অবিশ্বাস্য, অসাধারণ জয় তুলে মুশফিক, সাকিব, তামিমরা জবাব দিলেন পন্টিং, ইয়ান চ্যাপেলদের— ১১ বছর আগে যারা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট খেলা মানেই সময়ের অপচয়। ’ এই জয়ে ২ কোটি টাকা বোনাস ঘোষণা করেছে বিসিবি। এ ছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনাল খেলায় টাইগাররা পাবেন আরও ৪ কোটি টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *