কক্সবাজারের আন্তর্জাতিকপাড়ায় এখন ঘন ঘন সভা হচ্ছে। মাথায় পতাকাদণ্ড বসানো বিদেশি সংস্থার করমুক্ত গাড়িগুলোর দম নেওয়ার ফুরসত মিলছে না, শুধু ছোটাছুটি। ফোনের পর ফোন আসছে—ঢাকা-জেনেভা-নিউইয়র্ক। কারও চোখে ঘুম নেই। বাড়িঘর ছেড়ে যাঁরা এসব সংস্থার চাকরি করতে এসেছেন, তাঁদের আসন্ন ঈদে বোধ হয় বাড়ি যাওয়া হবে না। বাড়িঘর ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ নাফ নদী পেরিয়ে ঘুমধুমের জঙ্গলের পথে নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তের কড়া পাহারা উপেক্ষা করে আবারও আসছে। অনেকেই দুই সীমান্তের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। গত বছর এসেছিল শয়ে শয়ে। এবার আসছে হাজারে হাজারে, কাতারে কাতারে। জাতিসংঘের মহাসচিব আশ্রয় দিতে বলেছেন। পোপ আসছেন বাংলাদেশে, পোপ যাবেন মিয়ানমারেও।
ক্ষুধায় কাতর তিন বছরের হাফিজ এসব কিছুই বোঝে না। এসেছে বু’জির সঙ্গে, তাঁকেই মা বলে। বড় বোন হামিদার বয়স কত হবে—১৮/১৯, বড়জোর কুড়ি। ঘুমধুমের জটিল পথে সারা রাত হেঁটে বালুখালীতে জায়গা না পেয়ে ফজরের কিছু পরে এসে দম নিয়েছে কুতুপালংয়ে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। তবু কেঁদেই চলেছে একই কথা বলে। অনেক কষ্ট করে উদ্ধার করি সেই কথার মর্মবাণী, ‘চ মাই ঘর যাইম’, চলো মা, ঘরে ফিরে যাই। হাফিজ বাড়ি যেতে চায়। পুলিশ, দারগা, হুজুর, এনজিওকর্মীর ভিড় তার ভালো লাগছে না। তিনি দিন, দুই রাতের এই বিরামহীন যাত্রার মধ্যে এক রাতের বিরতি ছিল সীমান্তে। ওরা তাড়িয়ে দিচ্ছে আর এরা ঢুকতে দিচ্ছে না—এমন এক মাঝামাঝি জায়গায় সারা রাত ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। গলার আওয়াজ ক্রমে ক্ষীণ হতে থাকে হাফিজের। কিন্তু কানে জোর প্রতিধ্বনি তুলে বারবার বাজতে থাকে তার কথাটা—‘চ মাই ঘর যাইম’। হামিদার কোলেপিঠে বড় হচ্ছে হাফিজ। তাদের মা মারা গেছেন হাফিজের যখন বয়স তিন মাস। তিনি কি মিয়ানমার সেনা পুলিশ বা মগ গুন্ডাদের হাতে মারা পড়েছিলেন, না কোনো রোগ-শোকে মারা গেছেন, এ প্রশ্ন আর করতে মন টানল না। এসব ‘অনুভূতি’-মার্কা প্রশ্ন করতে কি ভালো লাগে?
এবারের শরণার্থীদের ভিড়ে হাফিজ আর হামিদাদের সংখ্যা বেশি। ৯১-এ যখন প্রথম মিয়ানমারের নাগরিকদের সঙ্গে কাজ করতে যাই, তখন দেখতাম, তারা পাড়া ধরে এক মাঝির (প্রতি ত্রিশ পরিবারের এক মাতব্বরকে ও দেশে মাঝি বলে) নেতৃত্বে আসত। মাঝিরা নিয়ন্ত্রণ করতেন চলে আসা শরণার্থীদের। এবার সব ভাঙা পরিবার, ছন্নছাড়া পরিবারের অর্ধেকটা বা শুধুই বাচ্চা বা নারীটা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কিশোরী-কিশোর, বালক-বালিকা আর মা-ছাড়া দুধের শিশু, চারদিকে থই থই। সোমালিয়া কুর্দিস্তান, এমনকি পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তেও এ রকম জটিল পরিস্থিতি কদাচিৎ নজরে এসেছে। এ দেশে এটা একেবারেই নতুন—এ রকম ছন্নছাড়া, পরিবারহারা মানুষের ঢল।
পরিবারবিচ্ছিন্ন কম বয়সের এই শরণার্থীদের সঠিক ব্যবস্থাপনা আর সুরক্ষার এলেম কি আমাদের আছে? জাতিসংঘের আকাশি রঙের পতাকা উড়িয়ে গাড়ির ডগায় মুলো বসিয়ে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের কাছে এ সম্পর্কে বিস্তর বইপুস্তক আছে। কিন্তু কথায় বলে, হাতি ঠেলা সহজ, কিন্তু আকাশি-নীল পতাকা নড়ানো কঠিন। তাদের নানা দপ্তরের মধ্যে নানা কাইজ্যা, নানা সীমারেখা—একের গরু অন্যের মাঠে চরানো নিষেধ। ইউএনএইচসিআর নিবন্ধিত ক্যাম্পের চৌহদ্দির মধ্যে থাকবে। বাইরে থাকবে জাতিসংঘের নতুন শরীর আইওএম। এসব সীমানা লঙ্ঘন করা যাবে না। আইওএমের আবার এ দেশে খুঁটি শক্ত—সম্প্রতি অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তাদের দায়মুক্তির সনদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাদের কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য আদালতে যাওয়া যাবে না। কুতুপালংয়ের পাহাড় কেটে, শিশুদের খেলার মাঠ নষ্ট করে তারা হাসপাতাল-ক্লিনিক বানাচ্ছে। এসব ক্লিনিকের বর্জ্য কী হবে, সেটা পরের কথা। কিন্তু পাহাড়ে যে ইট গাঁথা যাবে না, এটা তো পরিষ্কার। পাহাড়ধসের এত কাহিনির পরেও তাদের থামানোর কেউ নেই। সমন্বয় সভায় কেউ কেউ মিনমিন করে এসব বিষয়ে কিছু বলতে চাইলে তাঁর নটেগাছটা শুরুতেই মুড়িয়ে দেওয়া হয়। সভার বিবরণীতেও বিষয়টি রাখা হয়নি। সে অন্য প্রসঙ্গ—বারান্তরে আলাপ করা যাবে। তবে এই মুহূর্তে প্রয়োজন পরিবারবিচ্ছিন্ন কমবয়সী মানুষদের মানুষ হিসেবে সুরক্ষার ন্যায্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং পরিবারের সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব তাদের মিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
বালুখালীর ক্যাম্পে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন আবদুস সাত্তার। ঘনঘন মোবাইলে চেষ্টা করছিলেন কারও সঙ্গে যোগাযোগের। তাঁর কিশোরী মেয়ে হানুফা আটকে গিয়েছে ওপারে। প্রতিদিন গোলাগুলি হচ্ছে। আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশের মোবাইলে (বিশেষ একটা কোম্পানির সিম) ও দেশে প্রায় মংগদু পর্যন্ত কথা বলা ও শোনা যায়। মেয়ের মামাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন সাত্তার; যেন হানুফাকে ঘাট পর্যন্ত দিয়ে যায়। তারপর তিনিই ব্যবস্থা করবেন। গত অক্টোবরে যখন ভাইদের ছেড়ে শুধু নিজের পরিবার নিয়ে চলে আসেন সাত্তার, তখন সঙ্গে তাঁর কিশোরী মেয়েটাও ছিল। দুমাস আগে এক মামা ব্যবসার কাজে এ দেশে এলে মেয়েটি জিদ করে নানাবাড়ি চলে যায়। এখন ওখানে কিশোরীদের ঘোর বিপদ। মামারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, রাতে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন, যেন বাংলাদেশের একাত্তর। এ রকম দুঃসময়ে সোমত্ত নারীদের কে সুরক্ষা দেবে?
স্বজনহীন এমনই এক কিশোরীকে দুটো বস্তা আঁকড়ে বেহুঁশ পড়ে থাকতে দেখলাম কুতুপালংয়ের পথে। একাত্তরে প্রাগপুর-শিকারপুরের সীমান্ত লক্ষ্য করে ছুটতে থাকা হাজার হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে এ রকম অনেক অসহায় মানুষকে পড়ে থাকতে দেখেছি। সবাই কি ভারতের শিকারপুর কল্যাণী ক্যাম্পে পৌঁছাতে পেরেছিল? পৌঁছালেও ফিরতে পেরেছিল কি সবাই? তবে প্রথম দুয়েক সপ্তাহের অপ্রস্তুত ভাব কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক শরণার্থীর রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রায় সবাই নিবন্ধিত হয়েছিল।
আমরা যখন গাদন খেলার মতো বাধা দিয়ে ঠেকাতে পারছি না, তখন কী দোষ তাদের নিবন্ধন করলে? প্রতিটি শরণার্থীর অবস্থা, বয়স আর ওপারের ঠিকানাসহ নিবন্ধন করলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এবং বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আর বিবেকের কাছে পেশ করার মতো কিছু তথ্য অন্তত থাকত। মাস চারেক আগে মালয়েশিয়ার জাহাজ এসে যখন বলল, তাদের ত্রাণ শুধু নিবন্ধিত ক্যাম্পের বাইরে যারা আছে তাদের জন্য, তখন কী বিপদেই না পড়েছিল আমাদের সরকার। কাগজে-কলমে তো কিছু নেই!
সরকার জাতিসংঘ আর দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর এখন পয়লা কাজ হচ্ছে ‘তা রে না না না’ বন্ধ করে আশ্রয়ের আশায় আসা মিয়ানমারের সব নাগরিকের নাম-ঠিকানা-বয়স হাল সাকিন নিবন্ধন করা। একেবারে ডিজিটাল নিবন্ধন। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি এসেছে মিয়ানমারের কোনো কোনো মহল থেকে। তারা বলছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারের ভেতরই ‘সেফ জোন’ বা নিরাপত্তা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে রাখার ব্যবস্থা করার কথা। এ রকম অবস্থা সিরিয়ায় করা হয়েছিল, ইরাকে করার হয়েছিল। নতুন এ প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দরকার বাংলাদেশের। নিজেদের স্বার্থে, রোহিঙ্গাদের রক্ষায় এবং মানবতার প্রয়োজনে।