ইঞ্জিন সংকট কাটাতে ২০১১ সালে ৭০টি মিটার গেজ ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরপর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এগুলো সংগ্রহ করতে পারেনি সংস্থাটি। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থায়ন সংকট, দরপত্র নিয়ে জটিলতার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদের রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭০টি লোকোমোটিভ ক্রয়ে বিলম্বের কারণ জানতে চায় মন্ত্রণালয়ের কাছে, যার পরিপ্রেক্ষিতেই কমিটির কাছে প্রকল্পের অগ্রগতিসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরপর সংসদীয় কমিটির সভায় সব সমস্যা সমাধান করে জরুরি ভিত্তিতে লোকোমোটিভ ক্রয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি সুপারিশ করা হয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘৭০টি মিটার গেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ’ প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হলে তা ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়া হয়। ছয় বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ।
২০১১ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। সে সময় প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৯৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ইঞ্জিনগুলো বিডার্স ফিন্যান্স (ঋণের সংস্থান করবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান) পদ্ধতিতে কেনার সিদ্ধান্ত হয়। সুদসহ এ ঋণ পরিশোধ করবে বাংলাদেশ সরকার।
একনেকে অনুমোদনের পর ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। এসব প্রতিষ্ঠান শর্তপূরণে ব্যর্থ হলে একই বছরের ৪ জুলাই দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ দফায় তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করলেও প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৪ সালের ১৪ মে দ্বিতীয়বারের দরপত্রটি নন-রেসপনসিভ করার সুপারিশ করে রেলওয়ে।
দুবার দরপত্র আহ্বান করে ব্যর্থ হওয়ার পর দরপত্রে কিছু কৌশলগত ও কারিগরি পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে ইঞ্জিনগুলোর স্পেসিফিকেশনে হর্স পাওয়ার ১৬০০-১৬৫০ থেকে বাড়িয়ে ১৮০০-২০০০ হাজার করা হয়। এক্সেল লোড ১১ দশমিক ৯৬ থেকে বাড়িয়ে ১৫ টন করা হয়। আর ট্রাকশন সিস্টেম এসি-ডিসির স্থলে এসি-এসি করা হয়। এসব পরিবর্তন আনার পর ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর তৃতীয়বার আন্তর্জাতিক দরপত্র (দরপত্র নং- এমইসিএইচ/৭০এমজিলোকো/২০১১, পুনঃদরপত্র-১) আহ্বান করা হয়।
দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়ে দরপত্রটি ২০১৫ সালের ৩১ মে উন্মুক্ত করা হয়। মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে, যার দুটিকে কারিগরিভাবে গ্রহণযোগ্য ঘোষণা করে রেলওয়ে। যাচাই-বাছাইয়ের পর সর্বনিম্ন দরদাতা স্পেনের মেসার্স ভসলো এস্পানা এসএকে নির্বাচন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি নাম পরিবর্তন করে বর্তমানে মেসার্স স্ট্যাডলার রেল ভ্যালেন্সিয়া এসএ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জানা গেছে, প্রকল্পে সহজ শর্তে কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ দিতে রাজি হয়নি। এ কারণে অনমনীয় ঋণের চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ‘অনমনীয় ঋণ বিষয়ক স্থায়ী কমিটি’তে পাঠিয়েছে রেলওয়ে।
এদিকে দরপত্র ও অর্থায়ন জটিলতার পাশাপাশি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ‘কিছু মানুষ’ অসহযোগিতা করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার রেলের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, যার ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে রেলওয়ের কার্যক্রমে গতিশীলতা এসেছে। কিন্তু রেলওয়ের এ উন্নয়ন অনেকের কাছেই ভালো ঠেকছে না। একটি চক্র কাজ করছে, যারা রেলওয়েকে পিছিয়ে রাখতে চায়। ৭০টি মিটার গেজ ইঞ্জিন সংগ্রহ প্রকল্পেও এ ধরনের কিছু থাকতে পারে।’ তবে ‘চক্র’টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি রেলওয়ের মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, ‘আমরা এ প্রকল্পের পেছনে অনেক সময় ব্যয় করেছি। রেলওয়ের কার্যক্রম গতিশীল করতে ইঞ্জিনগুলো ভীষণ জরুরি।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের জুলাইয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দশমিক ৫ শতাংশ। অগ্রগতি প্রতিবেদনে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ১ জুন পর্যন্ত। আগের মাসের অগ্রগতি প্রতিবেদনে একই প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ১ জুন পর্যন্ত।
এ প্রকল্পে পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (প্রকল্প) আব্দুল মতিন চৌধুরী। তিনি হজ পালনের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে থাকায় বর্তমানে এ দায়িত্ব পালন করছেন রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (মেকানিক্যাল) ইফতিখার হোসেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রথমে দরপত্র ও অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা থাকায় এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে আমরা বসে নেই। ইআরডি ঋণ প্রস্তাবটি অনুমোদন দিলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।’
প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৭০টি লোকোমোটিভ জিজেল ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের জন্য ১ হাজার ৮৩৫ কোটি ৭৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৩ টাকা প্রস্তাব করে স্ট্যাডলার ভ্যালেন্সিয়া। এ হিসাবে প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম পড়বে ২৬ কোটি ২২ লাখ ৪৭ হাজার ৭৯১ টাকা।
সর্বশেষ চলতি বছরের ২০ জুলাই প্রকল্পটি নিয়ে নেগোসিয়েশন কমিটির দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনের জন্য দ্রুত পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। এর বাইরে ঋণসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আসার জন্যও দরদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হয়।
প্রকল্পটি সম্পর্কে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব (ভারপ্রাপ্ত) মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘মূলত ঋণ জটিলতার কারণেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পের পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকাও বিলম্বের আরেকটি কারণ। তবে সম্প্রতি আমরা বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছি। এ কারণে বলা যায়, প্রকল্পটি গতিশীলতা পেয়েছে। আশা করছি, খুব দ্রুত ইঞ্জিনগুলো কেনা হবে।’