শিশুদের মায়ের দুধের বিকল্প ও বাড়তি খাদ্য নিয়ন্ত্রণে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে আইন প্রণয়ন করে সরকার। যদিও বিধিমালা না থাকায় আইনটি পরিপালন হচ্ছিল না। অবশেষে আইন প্রণয়নের ৩ বছর ১০ মাস পর এ-সংক্রান্ত বিধিমালা জারি করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
৬ আগস্ট জারি করা বিধিমালাটি মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও তা ব্যবহারের সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা নামে পরিচিত হবে। বিধিমালা অনুযায়ী, এখন থেকে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও সেসব শিশুখাদ্য ব্যবহারের সরঞ্জামাদি আমদানি, স্থায়ীভাবে উত্পাদন, বিপণন, বিক্রি বা বিতরণের জন্য নিবন্ধন নিতে হবে।
বিধিমালার (৪) উপবিধি (৩)-এর অধীনে নিবন্ধন সনদ নবায়নের আবেদন মঞ্জুর বা নামঞ্জুর হওয়া পর্যন্ত ওই নিবন্ধন সনদ বহাল থাকবে এবং ওই নিবন্ধন সনদের ভিত্তিতে আমদানি ব্যতীত অন্যান্য কাজ করা যাবে।
এ বিষয়ে ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা. এসকে রায় বণিক বার্তাকে বলেন, আইনে বিকল্প খাদ্য ও শিশুখাদ্যের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হলেও এত দিন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত বিধান না থাকায় নিবন্ধন আবেদন নেয়া হয়নি। বিধিমালা প্রণয়নের ফলে এখন নিবন্ধন আবেদন গ্রহণ করা হবে। আইন অনুযায়ী সব শর্ত পূরণ করে যেসব কোম্পানি নিবন্ধনের আওতায় আসবে, এখন শুধু সেসব কোম্পানিই বাজারে থাকতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, বিধিমালার অভাবে এত দিন আইনের কিছু ধারা কার্যকর করা যায়নি। সেসব ধারা বাস্তবায়নে এ বিধিমালা সহায়তা করবে।
বিধিমালায় মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য ইত্যাদির বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও তা ব্যবহারের সরঞ্জামাদির (যেমন বোতল, চুষনি, কাপ ইত্যাদি) কোনো নমুনা কোনো শিশু, শিশুর মা বা তার পরিচর্যাকারী কিংবা কোনো স্বাস্থ্যকর্মীকে দেয়া যাবে না। পাশাপাশি বোতলে দুধ খাওয়ানোর শ্রেষ্ঠতার বিষয়ে কোনো বক্তৃতা বা বিবৃতি দেয়াসহ কোনো ছবি প্রদর্শন করা যাবে না। এছাড়া আরোপিত বিধিনিষেধের পরিপন্থী এবং আইনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করে, এ রকম কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না।
বিকল্প শিশু খাদ্য বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কৌশলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করে। এতে বুকের দুধের পরিবর্তে শিশুকে বাজার থেকে কিনে গুঁড়ো দুধসহ বিকল্প খাদ্য খাওয়ান অনেকে।
মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য ও সেসব শিশুখাদ্য ব্যবহারের সরঞ্জামাদির আমদানিকারক, স্থানীয়ভাবে উত্পাদনকারী, বিপণনকারী, বিক্রেতা বা বিতরণকারীর সহযোগিতা কিংবা অর্থায়নে অনেক সময় বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন হয়, যেখানে গর্ভবতী নারী, শিশুর মা, মাতৃদুগ্ধ প্রদানকারীসহ শিশুর পরিচর্যাকারীদের শিশু স্বাস্থ্য-বিষয়ক নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়।
বিশেষ করে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্যের
পুষ্টির মান বা তার ঝুঁকিমুক্ততা সম্পর্কিত অথবা শিশুর শারীরিক ও মানসিক উত্কর্ষের প্রলোভনসংবলিত নানা রকম বিভ্রান্তিকর বার্তা দেয়া হয় সেখানে। এজন্য বিধিমালায় এ ধরনের কার্যকলাপের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
বিধিমালায় আরো উল্লেখ রয়েছে, মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও সেসব শিশুখাদ্য ব্যবহারের সরঞ্জামাদির প্রচার-প্রচারণার লক্ষ্যে সেসব প্রস্তুতকারক, আমদানিকারক, স্থানীয়ভাবে উত্পাদনকারী, বিপণনকারী, বিক্রেতা বা বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান কোনো বিশেষ সপ্তাহ কিংবা দিবস পালন করতে পারবে না। এছাড়া সেসব শিশুখাদ্য বা সরঞ্জামাদি বিক্রির পরিমাণের ওপর কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের কোনো কর্মচারী অথবা কোনো বিক্রেতাকে কমিশন, আর্থিক সুবিধা বা উপহারসামগ্রী দিতে পারবে না।
মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও তা ব্যবহারের সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইনের ১২ ধারায় ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানির খাদ্যের কারণে শিশুর মৃত্যু হলে ওই অর্থ নির্ধারিত পদ্ধতিতে শিশুর পরিবারকে প্রদান করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর পরিবারকে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানের পদ্ধতি স্পষ্ট করা হয়েছে বিধিমালায়। এতে বলা হয়, আইনের ধারা ১২-এর উপধারা (২)-এর অধীন আদালত কর্তৃক কোনো অর্থদণ্ড প্রদান করা হলে তা ওই উপধারার অধীন ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর মা-বাবা বা অভিভাবকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেয়ার জন্য আদালত দণ্ডিত ব্যক্তিকে আদেশ করতে পারবেন। দণ্ডিত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ যথাযথভাবে প্রতিপালন না করলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আদালতকে অবহিত করবে।
বিধিমালার ১০ ধারায় জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের কাছ থেকে এসব খাদ্যের নিবন্ধন নেয়ার পদ্ধতি ও শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিধিমালার ৮ ধারায় জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এতে একজন চেয়ারম্যানসহ নয়জন সদস্য থাকবেন। আইন ও বিধিমালা কার্যকরকরণের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে সরকারকে পরামর্শ দেবেন তারা। একই সঙ্গে মাতৃদুগ্ধ পান না করানোর জন্য সম্ভাব্য ক্ষতিকর সমস্যা চিহ্নিত করা এবং তা নিরসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারকে সুপারিশ করবে এ উপদেষ্টা কমিটি।
শিশুখাদ্য নিবন্ধনের বিষয়ে জানতে চাইলে নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেডের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর নকীব খান বলেন, নিবন্ধন তো নতুন কিছু নয়। নিবন্ধন আগেও ছিল। তবে বিধিমালা না দেখে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।