তেইশ বছর বয়সেই যুবক গুরমিত সিং এর অন্যজীবন শুরু। ধীরে ধীরে হুজুর মহারাজ গুরমিত রাম রহিম জি পরিচয় গড়েন। লাখ লাখ অনুসারী। ক্ষমতা। বিলাসবহুল জীবন। হাজার একর ভূমিতে নিজস্ব সাম্রাজ্য। সুন্দরী তরুণীদের জড়ো করে সাজিয়েছিলেন ডেরা। নিজের ধর্মগুরুর পরিচয়ের আড়ালে এই ডেরায় অন্যরূপ ছিল তার। ডেরাকে গড়ে তুলেছিলেন খুন, ধর্ষণসহ অপকর্মের নিরাপদ আস্তানা। লাখো ভক্তের বাহুবল আর কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের মাধ্যমে নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন মেসেঞ্জার অব গড। কিন্তু গুরুর অপকর্মের বলি দুই সাধ্বির অভিযোগ আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে দিল স্বঘোষিত এই মেসেঞ্জার অব গডকে। নিজের নারী ভক্তদের ধর্ষণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলেন বিশেষ সিবিআই আদালতের রায়ে। বিশেষ তপস্বী পরিচয় ধারণ করার আগে অবশ্য গুরমিত একজন সাধারণ আম-জনতার মতোই ছিলেন। ইন্ডিয়াটুডেতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার শুরুটা একেবারে সাদামাটা ছিল না। তার বাবা, মাঘার সিং ছিলেন রাজস্থানের শ্রী গঙ্গানগর জেলার এক জমিদার। তার মা, নসীব কওর ছিলেন ধার্মিক গৃহিণী। ডেরা সাচ্ছা সৌদা আশ্রমের সঙ্গে মাঘার সিংয়ের পরিচয় তার জীবনের একেবারে শুরুর দিকেই হয়েছিল। বাবা বালুচিস্তানী বেপারওয়াহ মাস্তানা জি প্রতিষ্ঠিত আশ্রমটি সমাজের নিচু স্তর ও দলিত সম্প্রদায়ের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বাড়তে থাকে আশ্রমের অনুসারী। উঁচু সম্প্রদায়ের শিখ ও দলিতদের মধ্যে থাকা বৈষম্য এ ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। অভিজাত সমপ্রদায়ের শিখরা কখনোই দালিতদের নিজেদের সমান মনে করতো না। একসঙ্গে প্রার্থনাও করতো না। মাঘার সিং ছিলেন ‘জাত শিখ’। আশ্রমের প্রধান শাহ সাতনাম ছিলেন ক্ষত্রী শিখ। সাতনাম ছিলেন মাস্তানার উত্তরসূরি আর মাঘার সিং ছিলেন তার অনুসারী। মাঘার সিং সাতনামের ধর্মীয় চিন্তাধারা ছড়িয়ে দিতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তার ছেলে গুরমিত সিং অবশ্য তার মতন এতটা ধার্মিক ছিলেন না, তবে প্রায় সময়ই তার বাবার সঙ্গে আশ্রমে যেতেন।
একদিন গুরমিতের বন্ধু গুরজান্ত সিং নিজের চাচাকে হত্যার দায়ে জেলে যায়। জেলে থাকা খালিস্তানি জঙ্গিদের সংস্পর্শে এসে নিজেও হয়ে উঠেন সন্ত্রাসী। এর মধ্যে গুরমিত আশ্রমে প্রচুর সময় দিতে থাকে। হয়ে যায় আশ্রমের স্থায়ী কর্মী। তারপর হঠাৎ করেই শাহ সাতনাম ঘোষণা দেন তিনি অবসর গ্রহণ করবেন। তবে তার আগে একজন উত্তরসূরিকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে চান। আর এক আচমকা ঘোষণায়, গুরমিত হয়ে গেলেন সেই উত্তরসূরি। তার নতুন নাম হলো, হুজুর মহারাজ গুরমিত রাম রহিম। স্থানীয়দের অনেকে বলে থাকেন, সাতনামের ওই ঘোষণার পেছনে, গুজরান্ত সিং ও গুজরান্ত সিংয়ের একটি পিস্তলের কারসাজি ছিল। তবে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আশ্রম প্রধান হিসেবে গুরমিত তার ক্ষমতার বিস্তৃতি ঘটাতে থাকে। এক ছেলে ও দুই কন্যার বাবা হন গুরমিত। তবে তার ওই পরিবারের কথাও তিনি জনসম্মুখে অস্বীকার করেছেন। যদিও তারা তার সঙ্গে আশ্রমেই বসবাস করতো। আর সেই আশ্রমে গুরমিত থাকতেন সাধ্বী (সাদা কাপড় পরিহিত নারী অনুসারী) দিয়ে ঘেরা। এর মধ্যে মোহালি শহরের নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে নিহত হয় গুজরান্ত। পরবর্তীতে গুরমিত হানিপ্রীত নামে আরো এক যুবতী মেয়েকে দত্তক নেন। তার তিন কন্যা নিজেদের বাবার পরী (পাপা’স এঞ্জেসল) বলে ডাকে। তার বাকি সব পূজারিরা তাকে পিতাজি বা পাপা জি বলেই সম্বোধন করে। তার নিজের দুই কন্যা চরনপ্রীত ও অমরপ্রীতকে পরবর্তীতে গুরমিত সিং তার পছন্দের দুই পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেন। তার বড় মেয়ে চরনপ্রীতের দুই ছেলের অদ্ভুত নাম রাখেন তিনি সুইটলাক সিং ও সুবাহ-ই-দিল। তার মেয়েরা তার নির্মিত ছবি এমএসজিতে অভিনয় করেছেন। তার জামাতারা তাকে আশ্রমের ব্যবসার দেখাশোনায় সহায়তা করে থাকেন। তার অপর এক পুত্র জাসমিত ইনসানের বিয়ে হয় পাঞ্জাব রাজ্যের কংগ্রেস নেতার মেয়ে হুসানমীত কওর এর সঙ্গে। রাম রহিমের খ্যাতি বাড়তেই থাকে। প্রায় হাজার একর জমির মাঝখানে আয়নায় মোড়া এক প্রাসাদ নির্মাণ করেন। নাম দেন ‘বাবা কি গুফা’। দামি আসবাব, সোফা, পর্দায় সাজানো বিলাসবহুল সেই প্রাসাদেই বাস শুরু। সেখানেই তিনি ধ্যান করতেন। আর পাশাপাশি নারী ভক্তদের নিয়ে মেতে উঠতেন বিশেষ প্রকারের ধ্যানে। সাধ্বীদের ওপর চালাতেন যৌন নির্যাতনের ছরি। গুফায় তাকে ঘিরে থাকতো ২০০ জনেরও বেশি বাছাই করা শিষ্য। তাদের চুল খোলা। পরনে সাধ্বীদের মতো দুধসাদা রঙের পোশাক। এঁরাই রাম রহিমের যত্ন-আত্তি, দেখভাল করতো। এমনই দুই শিষ্যাকে ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বাবা রাম রহিম। এক সময়ে বাবার ‘গুফা’য় অতিথি হওয়া বিহারের সাংবাদিক পুষপরাজ জানিয়েছেন, সেখানে আছে মেয়েদের স্কুল ‘পরীলোক’। তার সব পড়ুয়াই সুন্দরী। কারণ, বাবাজি মনে করেন ‘খুবসুরত’ হলেই মেধাবী হয়। সেই গুফায় প্রবেশাধিকার আছে মাত্র কয়েক জনের। তাও আঙুলের ছাপ, চোখের মণি-র মতো বায়োমেট্রিক তথ্য মিললে তবেই ভিতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে।
সে তার অনুসারীদের মধ্য থেকে কাওকে ঠিক করতো- ওই সাধ্বীকে নিজের দেহ তার কাছে সমর্পণ করতে বলতো। তার নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী অনুসারীরা পরবর্তীতে ওই আশ্রমেই থাকতো। অপেক্ষা করতো, হয়তো কোনদিন রাম রহিমের কোন পুরুষ অনুসারীর সঙ্গে বিয়ে দেয়া হবে তাদের। প্রাচীন কালের দাসদের মতন আধুনিক দাস হয়ে জীবন-যাপন করতো। মেনে নিতো বাবার সব আদেশ। তিনি যে এইসব নির্যাতন চালাতেন তা খুব একটা গোপন ছিল না। তার ব্যক্তিগত ‘আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বার’ তার বিশ্বস্ত লোকরা পাহারা দিতো। আর তাদের পাহারায় ভেতরে তিনি তার অনুসারীদের ওপর চালাতেন অমানুষিক নির্যাতন, করতেন ধর্ষণ। ধর্ষণটাকে বৈধ করার জন্যে একটা নামও দেয়া হয়েছে- ‘মাফি’। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, কিছু নারী বিশ্বাস করতেন এই ধর্ষণ আসলে আশীর্বাদ। তবে কেউ কেউ ভিন্ন চিন্তার পোষক ছিলেন। তেমন দুই নারীই তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করে বসেন। দু’জনের ঘটনা একইরকম ছিল। প্রাথমিক অভিযোগকারী, যিনি বেনামি চিঠি পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। যার চিঠির সূত্র ধরে ২০০২ সালে সিবিআই একটি এফআইআর করে। ওই অভিযোগকারী আদালতকে বলেন যে, পিতাজি তাকে ১৯৯৯ সালের আগস্টের ২৮ তারিখ রাতে তার গুফায় ডাকেন- তাকে মাফি দিবেন বলে। এমনকি তাকে ধর্ষণ করতে না দিলে খুন করার হুমকিও দেন। অভিযোগকারী ওই নারী তার ভাইকে এ বিষয় সম্বন্ধে জানান। তার ভাই তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে পরবর্তীতে তার ভাইকে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় নারীর ঘটনাও অনেকটা একই রকম। ওই নারীর বাবা-মা আশ্রমের একটি স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। তিনি গুরুর চেম্বার পাহারা দিচ্ছিলেন। গুরু তাকে ভেতরে ডাকেন, তিনি গুরুর আদেশ মেনে নিয়ে ভেতরে যান। ভেতরে গিয়ে যা দেখেন তা এক কথায় তাকে বৈদ্যুতিক শকই দিয়েছিল। পিতাজি বিছানায় শুয়ে আছেন- উলঙ্গ হয়ে। ওই নারী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। বাকি সবার মতো সেও ধর্ষিত হলো। তবে পরবর্তীতে সে আশ্রম থেকে পালিয়ে যায়। সিবিআই কোর্টে গিয়ে তার গল্প বাকি দুনিয়াকে শোনায়।
ধর্মগুরু হলেও রাম রহিমের পছন্দ শিফনের রঙবেরঙের জামা, বাহারি জুতো। তার জামাকাপড় তৈরির জন্য নিজস্ব ফ্যাশন ডিজাইনার রয়েছেন। রয়েছেন নিজস্ব ‘হেয়ার ড্রেসার’-ও। রাম রহিমের কনভয়ে বিলাসবহুল ১০০টি গাড়ি। তার মধ্যে ১৬টি কালো রঙের ফোর্ড এনডেভার। বাবা প্রাসাদ থেকে বের হলে সব গাড়ি তাঁবু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। বাবা নিজেই ঠিক করেন, তিনি কোন গাড়িতে উঠবেন। আশ্রমে নিজের ব্যাটারিচালিত গাড়িতেই ঘোরেন তিনি। সিরসায় ডেরা সচ্চা সৌদার এই সদর দপ্তর আসলে নিছক আশ্রম নয়। ছোটখাটো শহর। ডেরা-র ভিতরেই চাল, ডাল, আনাজের চাষ হয়। হোটেল, সিনেমা হল, স্কুল, রেস্তরাঁ, মাল্টি-সেপশ্যালিটি হাসপাতাল, স্টুডিও, বায়ো-গ্যাস কারখানা, পেট্রল পামপ, সংবাদপত্রের ছাপাখানা সবই রয়েছে। একসঙ্গে ১০ হাজার জামাকাপড় কাচার ক্ষমতাসমপন্ন ওয়াশিং মেশিনও রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে কন্ট্রোল রুম, গোটা ডেরা জুড়ে নজরদারি ব্যবস্থা।
ডেরা-র বাইরেও রাম রহিমের দাপট কম নয়। ডেরা সচ্চা সৌদা সিরসায় একটি নিজস্ব বাজার তৈরি করেছে। সেখানে সব দোকানেরই নাম শুরু সচ দিয়ে। সিরসা ছাড়াও দেশেবিদেশে আরো ৪৬টি আশ্রম রয়েছে রাম রহিমের। তার ‘এমএসজি’ ব্র্যান্ডের শ্যামপু-তেল-সাবানের মতো হাজারো সামগ্রীর ব্যবসাও চলে এই আশ্রম থেকেই। আশ্রমে রাম রহিমের প্রবচন শুনতে দিনে গড়ে ৩০ হাজার লোক জড়ো হয়। মাত্র ছ’মিনিট ভক্তদের উপদেশ দেন। তার পরেই মঞ্চে ডিজে উঠে গান বাজাতে শুরু করেন।
মাত্র দু’সপ্তাহ আগেই সিরসার ডেরা-য় ‘মিউজিক্যাল কার্নিভাল’-এর আয়োজন হয়েছিল। ১২ই আগস্ট রাতের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন অন্তত ৭০ লাখ মানুষ। মাঝরাতে মঞ্চে ওঠেন রাম রহিম। অদ্ভুত দর্শন লাল রঙের আলো ঝলমলে গাড়িতে। তার পর গান শোনাতে শুরু করেন। জলসা চলে রাত তিনটে পর্যন্ত। রাম রহিম অবশ্য শ’খানেক কনসার্ট করেছেন। বাবাজি ১৫ই আগস্টেই ৫০ বছরে পা দিলেন। সেদিন ৩ ইঞ্চি মোটা, ৪২৭.২৫ বর্গফুটের কেক তৈরি হয়েছিল। তার উপরে একসঙ্গে দেড় লাখ মোমবাতি জ্বালানো হয়েছিল।