শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য নিবিড় সংহতির প্রত্যাশাকে সামনে রেখে আজ বুধবার একমঞ্চে বসছেন দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের রাষ্ট্র/ সরকারপ্রধানরা। আর এর মধ্য দিয়ে আজ শুরু হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) দুই দিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলন। এবারের সম্মেলনে সার্ককে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়াকে একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়নে রূপান্তর করার লক্ষ্যেও কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া সার্কে নতুন পর্যবেক্ষক না নেওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে সবাই একমত হয়েছেন।
আঞ্চলিক সংযোগ (কানেক্টিভিটি) সৃষ্টির লক্ষ্যে মোটরযান চলাচল, রেল যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতাবিষয়ক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি এবারের সম্মেলনে স্বাক্ষরের কথা থাকলেও তা প্রায় পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। অন্তত একটি চুক্তি হিসেবে জ্বালানি খাতে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে গত রাতেও আলোচনা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের নভেম্বরে মালদ্বীপের আদ্দু দ্বীপে সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের তিন বছর পর আজ আবারও সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ সুবাদে দক্ষিণ এশিয়ার ১৭০ কোটি মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে আজ সকালে কাঠমাণ্ডুর সিটি হলে একমঞ্চে বসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লিয়নচেন তেশারিং তোগবি, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ গনি ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামেন আবদুল গাইয়ুম। এবারের সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা আজ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সার্ক সভাপতির দায়িত্ব নেবেন। সার্কের অন্য নেতারা গতকালই কাঠমাণ্ডু পৌঁছেছেন।
সার্ককে আরো কার্যকর ও গতিশীল করার সিদ্ধান্ত
সম্মেলনে সার্কের ৯ পর্যবেক্ষক অস্ট্রেলিয়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইরান, জাপান, মরিশাস, মিয়ানমার, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও অংশ নেবেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ওই দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল।
গত শনিবার সার্কের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের বৈঠকের মধ্য দিয়ে এবারের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর রবিবার ও সোমবার পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক। প্রস্তাবিত বহুল প্রত্যাশিত তিন চুক্তি নিয়ে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। চুক্তিগুলোর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে একাধিক দেশ বিশেষ করে পাকিস্তান বেশ অনমনীয় ছিল। এ ছাড়া চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি একাধিক দেশ।
গতকাল সন্ধ্যায় কাঠমাণ্ডুর সোয়েলটি হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘যে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা বলা হচ্ছিল, তা একটু সমস্যায় পড়ে গেছে। তবে অন্তত একটি চুক্তি হিসেবে জ্বালানি খাতে সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামো চুক্তিটি স্বাক্ষরের ব্যাপারে বাংলাদেশ এখনো আশাবাদী।’
ওই চুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে নৈশভোজের পর আবারও বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দীর্ঘ তিন বছর চলমান সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর ঐকমত্যের অভাবে একটি চুক্তিও যদি স্বাক্ষর করা না যায় তাহলে তা সংস্থাটির ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য হতে পারে। তাই অন্তত একটি চুক্তি স্বাক্ষরের জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন সার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, সার্ককে গতিশীল ও কার্যকর সংস্থায় পরিণত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে সার্কের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে। এ অঞ্চলের মানুষের সত্যিকারের উন্নয়নের স্বার্থে সার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আঞ্চলিক প্রকল্পগুলোর সময়ানুগ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে স্ট্যান্ডিং কমিটি ও প্রোগ্রামিং কমিটির সাম্প্রতিক সুপারিশগুলো আলোচনা ও অনুমোদন করা হয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্য, অর্থ, যোগাযোগ, জ্বালানি, দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে সময়ানুগ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তারুণ্য এ অঞ্চলের একটি বড় সম্পদ। একে প্রকৃত অর্থে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে আমরা আহ্বান জানিয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, এর মাধ্যমে তারুণ্যকে মানবসম্পদে রূপান্তর করার মাধ্যমে ও তাদের অবদানের ফলে দক্ষিণ এশিয়াকে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গতকালের বৈঠকে একটি গবেষণা, দুটি কর্মকাঠামো এবং একটি সংকলন উদ্বোধন করা হয়েছে। এগুলো হলো দক্ষিণ এশিয়ায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ও দারিদ্র্য বিমোচনে সেরা চর্চা, স্যানিটেশনবিষয়ক সার্ক আঞ্চলিক কর্মকাঠামো, পুষ্টিবিষয়ক সার্ক আঞ্চলিক কর্মকাঠামো ও দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নের লক্ষ্যে পরবর্তী পদক্ষেপ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, গতকালের বৈঠকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রোগ্রামিং কমিটিতে সার্কের চার্টার বডিতে উন্নীতকরণ, পরবর্তী সার্ক সম্মেলনগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদস্য দেশগুলোর মতামত গ্রহণের জন্য সার্ক সচিবালয়কে নির্দেশনা প্রদান, দক্ষিণ এশিয়ার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) তৃতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা (সেনসেটিভ লিস্ট) কমানোর লক্ষ্যে সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে অনুরোধের তালিকা ও প্রস্তাবের তালিকা সার্ক সচিবালয়ে প্রেরণের জন্য আহ্বান, যেসব দেশ সার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেসের (সাটিস) চূড়ান্ত অফার লিস্ট জমা দেয়নি তাদের অনতিবিলম্বে তা সার্ক সচিবালয়ে প্রেরণের জন্য আহ্বান অন্যতম।
এ ছাড়া আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতি সমীক্ষার দ্বিতীয় পর্যায়ের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা ও এ লক্ষ্যে ‘সাফটা কমিটি অব এক্সপার্টস’কে সমীক্ষার সুপারিশ বিবেচনা করার লক্ষ্যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সার্ক উন্নয়ন তহবিলের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো শাখা চালু করার সুপারিশ, সার্ক উন্নয়ন তহবিলের সচিবালয়কে জ্বালানি ও যোগাযোগবিষয়ক উদ্ভাবনীমূলক আঞ্চলিক প্রকল্প প্রণয়নের ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান, দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে ‘সার্ক ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’ (সাবেক সার্ক রিজিওনাল পোভার্টি প্রোফাইল) এখন থেকে দ্বিবার্ষিক ভিত্তিতে প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, জাতিসংঘে চূড়ান্তকরণ সাপেক্ষে ২০১৫ সাল-পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডা দক্ষিণ এশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আরো প্রাসঙ্গিক রূপ দেওয়ার জন্য একটি আন্তসরকার প্রক্রিয়া শুরু জরুরি ও স্বাভাবিক অবস্থায় খাদ্য সংকটে সার্ক খাদ্য ভাণ্ডারের খাদ্যশস্য ব্যবহারের ব্যাপারে সদস্য দেশগুলোর ‘থ্রেশল্ড লিমিট’ বিলোপের মাধ্যমে সার্ক খাদ্য ভাণ্ডারকে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় অবস্থিত সার্ক কৃষিকেন্দ্র কর্তৃক গৃহীত এবং সফলভাবে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পের পর্যালোচনা এবং ‘হাইলি পেথোজেনিক অ্যান্ড ইমাজিং ডিজিজ’ (এইচপিইডি) প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠিত রিজিওনাল সাপোর্ট ইউনিট (আরএসইউ) ও ‘রিজিওনাল ইপিডেমিলোজি সেন্টার’কে (আরইসি) তাদের প্রকল্প পর্যায়ের শেষে সার্ক কৃষিকেন্দ্রে স্থানান্তর, দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্বারোপ এবং বাংলাদেশসহ সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে আরো বেশি ছাত্র ও শিক্ষককে সুযোগ প্রদান এবং সাউথ এশিয়ান উইম্যান ডেভেলপমেন্ট ফোরামকে (এসএডাব্লিউএফ) সার্কের স্বীকৃত সংগঠনের স্বীকৃতি প্রদান এবং সার্কে নতুন পর্যবেক্ষক নেওয়ার ব্যাপারে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সম্মেলনের ফাঁকে আজ একাধিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক : আজ সকালে সিটি হলে সার্কের অন্য নেতাদের সঙ্গে শেখ হাসিনাও বক্তব্য দেবেন। ওই দিন বিকেলে নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালাসহ আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ড. আশরাফ গণি ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন গাইয়ুমের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে। এ ছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক হতে পারে। রাতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত নৈশ ভোজে যোগ দেবেন।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার সম্মেলনের শেষ দিন শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য সার্ক নেতাদের নিয়ে যাওয়া হবে কাঠমাণ্ডু থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ধুলিখেল শহরে। সেখানেই হবে তাঁদের ‘রিট্রিট সেশন’। আট দেশের সরকারপ্রধানরা সেখানে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে সার্কসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করবেন। ধুলিখেল থেকে ফিরে তাঁরা শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সেখানে কাঠমাণ্ডু ঘোষণা করা হবে। অন্য সরকারপ্রধানদের সঙ্গে শেখ হাসিনাও কাঠমাণ্ডুর রাষ্ট্রপতি ভবনে নেপালের প্রেসিডেন্ট ড. রামবরণ যাদবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তাঁরা নেপালের রাষ্ট্রপতির দেওয়া ভোজসভায়ও যোগ দেবেন। শুক্রবার দুপুরে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার কথা।