ক্ষেতের ফসল গেছে। মরে গেছে মাছ, গবাদি পশু। বানে ভেসেছে বসতবাড়ি। জীর্ণ হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এমন দুর্যোগে কেমন আছে হাওড়ের মানুষ? বিপর্যয় মোকাবেলায় বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রমের কী অবস্থা? হাওড়ের এ সময়ের বৃত্তান্ত নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন শেষ পর্ব
বাড়ির সামনে বা পেছনে হাওড়ের পানির মধ্যেই বাঁশ ও বস্তা দিয়ে তৈরি ছোট ছোট ঘর। কোনোটায় আবার বাঁশ-বস্তা কিছুই নেই। পুরনো ছেঁড়া কাপড় দিয়ে ভেতরটা আড়াল রাখার চেষ্টামাত্র। উপর দিকটা নিরাবরণ, নিচেও তাই। বসতঘর থেকে বাঁশের সাঁকো মাড়িয়ে সেই ঘরে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারে হাওড়পাড়ের মানুষ।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জের দিরাই, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দেখা গেছে এমন শৌচাগার। আর এসব খোলা শৌচাগার থেকে মলমূত্র ছড়াচ্ছে হাওড়ের পানিতে।
হাওড়বেষ্টিত এলাকাগুলোয় স্যানিটেশনের বালাই নেই। সরকারি তথ্য বলছে, সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকায় স্যানিটেশন সুবিধাবঞ্চিত আছে ৬০ শতাংশ মানুষ। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরো বেশি। যারা স্যানিটেশনের সুবিধার আওতায় আছেন, তাদের প্রায় সবাই শহরের বাসিন্দা। অপেক্ষাকৃত গ্রামের, হাওড়তীরবর্তী এলাকাগুলোর মানুষের প্রায় সবাই খোলা টয়লেট ব্যবহার করেন, যদিও এতে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। চলমান বন্যার কারণে এ ঝুঁকি আরো বেড়েছে। বন্যার কারণে ঘরবাড়িতে ঢুকে পড়েছে হাওড়ের দূষিত পানি। ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের হাওড়পাড়ের মানুষ।
হাওড় ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, হাওড় এলাকার বেশির ভাগ গ্রামে একটাও পাকা টয়লেট নেই। তারা যে পানিতে মলমূত্র ত্যাগ করেন, সে পানিতেই গোসল সারেন। কাপড়-চোপড় ও থালাবাসনও ধৌত করেন ওই পানিতেই। এ কারণে হাওড় এলাকার মানুষের মধ্যে অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। চলমান বন্যার মৌসুমে তা অনেক গুণ বেড়ে গেছে।
স্যানিটেশন সুবিধাবঞ্চিত হাওড়পাড়ের বাসিন্দাদের রোগাক্রান্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাও। হাকালুকি হাওড়তীরবর্তী মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আহমদ হোসেন বলেন, স্যানিটেশন সুবিধা না থাকায় হাওড় এলাকার অনেক মানুষ পেটের পীড়া ও ডায়রিয়ায় ভোগেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা এসব রোগে আক্রান্ত হয়। তবে তা মহামারী আকার ধারণ করেনি বলে জানান তিনি।
দিরাই উপজেলার তাড়ল এলাকার বাসিন্দা আনিছা বেগম। স্যানিটারি ল্যাট্রিন নেই তাদের। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বড় হওয়া আনিছার ছেলে শাহানুর মিয়ার তিনদিন ধরে ডায়রিয়া। কিন্তু ছেলেকে চিকিত্সকের কাছে নেননি তিনি, বাড়িতেই স্যালাইন তৈরি করে খাওয়াচ্ছেন। আনিছা বলেন, ‘চাইরোবায় পানি, ডাক্তর পাইপাতম কই’ (চারদিকে পানি, চিকিত্সক পাবো কোথায়?)।
স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি তৈরির জন্য টাকা পাব কোথায়? তাছাড়া বসানোর জায়গাও তো নেই! বর্ষা মৌসুমে সব পানিতে ভাসিয়ে নেয়। আজ এক জায়গায় তো কাল আরেক জায়গায় খোলা শৌচাগার তৈরি করতে হয়।
একই কথা বলেন তাহিরপুরের বাদাঘাট এলাকার আব্দুল জলিল। তিনি জানান, স্যানিটারি ল্যাট্রিন বসালে প্রতি বছর বন্যার পানিতে তা ভেসে যায়। তাছাড়া এখানকার লোকজন খুবই গরিব। দুবেলা ভাত জোগাড় করার সামর্থ্যও নেই তাদের।
সরকারিভাবে সমতল ভূমির জন্য তিন রিং ও এক স্ল্যাবের যে স্যানিটারি ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়, তা হাওড় এলাকার জন্য টেকসই নয় বলে জানান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এসব ল্যাট্রিন বন্যার সময় পানির স্রোতে ভেসে যায়। তাছাড়া এখানে সমতল ভূমিও নেই। হাওড়ের মাঝখানে টুকরো টুকরো সমতল ভূমিতে অনেকগুলো পরিবার গাদাগাদি করে থাকে। কোথাও স্যানিটারি টয়লেট তৈরি করে দিলেও হাওড়ের লোকজন তা স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে পারে না। ফলে হাওড় এলাকাকে স্যানিটেশন সুবিধার আওতায় আনা বেশ চ্যালেঞ্জিং।
সর্বশেষ জাতীয় আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে মোট ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩০৯টি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই লাখ পরিবার স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহার করে না বলে জানায় সুনামগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
জানা যায়, ২০১০ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষকে স্যানিটেশনের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে ২০১০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এর পর ২০১৫ সালে ৯৯ শতাংশ মানুষকে স্যানিটেশনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়। তবে সরকারের এমন দাবি হাওড় এলাকার জন্য সত্য নয়।
হাওড় এলাকায় স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আইডিয়ার নির্বাহী পরিচালক নজমুল হক বলেন, সরকারি হিসাবে ৯৯ শতাংশ জনগণকে স্যানিটেশনের আওতায় আনা হয়েছে বলা হলেও উন্নত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাত্র ৬১ শতাংশ মানুষ।
তিনি বলেন, হাওড় অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই স্যানিটেশন সুবিধা বঞ্চিত। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো যে হিসাব দিয়ে থাকে, তার চেয়েও বেশি মানুষ স্যানিটেশন সুবিধার বাইরে আছে। হাওড়ে স্যানিটেশন নিয়ে অনেক কাজ করা হলেও সমন্বয়হীনতার অভাবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না।