প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছে পুরো বিশ্ব। তবে এক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়োগযোগ্য জমির প্রাপ্যতা একটি বড় বিষয়। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) এক গবেষণা বলছে, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আবাদি জমির মাত্র ১৫ শতাংশ প্রযুক্তি বাস্তবায়নযোগ্য, যদিও বাংলাদেশে ৭৬ শতাংশ জমিতেই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব।
ইফপ্রির গবেষণার তথ্যমতে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১৬ দেশের মধ্যে চাষযোগ্য জমিতে কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণ সক্ষমতায় বাংলাদেশ শীর্ষে। বাংলাদেশের ৭৬ শতাংশ জমি কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারের অনুকূলে থাকলেও ভারতে তা মাত্র ৩৫ শতাংশ। এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ডে ৩৪, কম্বোডিয়ায় ২৯, শ্রীলংকায় ২৭, পাকিস্তানে ২১, ভিয়েতনামে ১৯ , মালয়েশিয়া ও নেপালে ১৪, মিয়ানমারে ১২, ফিলিপাইনে ১১, চীনে ১০, ইন্দোনেশিয়ায় ৯, লাওসে ৮, ভুটানে ২ ও মঙ্গোলিয়ায় ১ শতাংশেরও কম জমি কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী।
প্রযুক্তি প্রয়োগের মতো যথেষ্ট জমি থাকা সত্ত্বে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। এ কারণে কৃষি উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি আসছে না দেশে।
এ বিষয়ে ইফপ্রির কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আকতার আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার যেমন করেছে, তেমনি অনেক দেশ আবার উপযুক্ত জমি না থাকায় তা পারছে না। কিন্তু বাংলাদেশের আবাদযোগ্য জমির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এখনো এসব জমিতে প্রযুক্তির যথাযোগ্য ব্যবহার হয়নি। এখানে প্রযুক্তির অনেক সময় অপব্যবহারও হচ্ছে, আবার পুরনো প্রযুক্তিও ব্যবহার হচ্ছে। ফলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত কৃষিপণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলেও সেটি হচ্ছে না, যার চিত্র আমরা কৃষি প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দেখতে পাই। প্রযুক্তি উদ্ভাবন হলেও তার যথেষ্ট ব্যবহার না হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, শতাধিক ধানের জাত উদ্ভাবিত হলেও তার সিংহভাগই মাঠে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
গত এক দশকে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে জানিয়ে তিনি বলেন, ধান উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াই এর অন্যতম কারণ। গ্রামাঞ্চলের মোট কৃষকের এক-তৃতীয়াংশ প্রান্তিক। তাদের নিজস্ব কোনো জমি নেই। আবার বেশির ভাগ কৃষকই স্বল্প শিক্ষিত ও প্রযুক্তি ব্যবহারে অজ্ঞ। ফলে কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারে তাদের পর্যাপ্ত প্রবেশগম্যতা নেই। এক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রযুক্তিটি কৃষকের কাছে পৌঁছাতে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নিতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে মোট ফসলি জমির পরিমাণ ১ কোটি ৫২ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর হলেও নিট ফসলি জমি ৭৯ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে চাষযোগ্য জমি ৭৪ লাখ ৬ হাজার। আর পতিত জমি ২ লাখ ১০ হাজার হেক্টর। এখানে শস্যের নিবিড়তা ১৯২ শতাংশ।
দেশে জমিতে বহু ফসল আবাদের সুযোগ তেমন একটা নেই। সিংহভাগ জমিই এক ও দুই ফসলি। তিন ফসলি জমির পরিমাণ খুব কম। সরকারি তথ্যমতে, দেশে এক ফসলি জমি আছে ২৩ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর। আর দুই ফসলি জমির পরিমাণ ৩৮ লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর। ফলে আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৭৩ শতাংশই এক ও দুই ফসলি জমি। মাত্র ২৭ শতাংশ বা ১৭ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে তিনটি ফসল আবাদ হয়ে থাকে। এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হলে জমিতে প্রযুক্তি প্রয়োগের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রযুক্তি কৃষকের কাছে পৌঁছানোর জন্য সরকারকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাত বীজ ও সেচসহ যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও বিপণনে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। কিন্তু সেগুলো কৃষকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাতগুলো সরকারিভাবে কৃষকের কাছে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। উন্নত বীজ উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় গবেষণা ছাড়াও সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এজন্য বেসরকারি খাতকে অর্থায়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নত জাত, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিপণনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে দেশের কৃষকদের। এ অবস্থায় তাদের ঘাতসহিষ্ণু জাতের প্রয়োজন। আবার বিভিন্ন দেশে উন্নত সারের ব্যবহার বাড়লেও প্রথাগত সার দিয়ে কৃষকরা জমি আবাদ করছেন। আবার দেশের জমিগুলো অনেক বেশি খণ্ডিত ও ছোট আয়তন হওয়ায় এসব জমিতে বড় বড় কৃষি যন্ত্রের পরিবর্তে ছোট ছোট যন্ত্রের প্রয়োজন বেশি। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।