ক্ষেতের ফসল গেছে। মরে গেছে মাছ, গবাদি পশু। বানে ভেসেছে বসতবাড়ি। জীর্ণ হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এমন দুর্যোগে কেমন আছে হাওড়ের মানুষ? বিপর্যয় মোকাবেলায় বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রমের কী অবস্থা? হাওড়ের এ সময়ের বৃত্তান্ত নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন পর্ব-০২
মার্চ পর্যন্তও সবুজ আহমেদের বিদ্যালয়ে গমন ছিল নিয়মিত। ছেলেকে নিয়ম করে বিদ্যালয়ে পাঠাতেন মা রাজিয়া বেগমও। গত এপ্রিলে অকালবন্যা সবকিছুই পাল্টে দিয়েছে। বই-খাতা ছেড়ে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সবুজ এখন হাওড়ের মৎস্যশিকারি।
এর কারণ জিজ্ঞাসা করতেই রাজিয়া বেগমের পাল্টা প্রশ্ন— ছেলে স্কুলে গেলে ভাত আসবে কোত্থেকে? বন্যায় ফসল গেছে। কাজও তেমন নেই। টুকটাক কিছু কাজ পেলেও একার আয়ে আর সংসার চলে না। তাই ছেলেকেও কাজে লাগিয়েছি। বাবার পাশাপাশি সেও এখন হাওড়ে মাছ ধরছে।
তাহিরপুর থেকে ধর্মপাশা উপজেলায় যেতে হয় টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ওপর দিয়ে ইঞ্জিন নৌকায়। গত সোমবার ইঞ্জিন নৌকায় যেতে যেতে হাওড়ের বুকে দেখা মেলে সবুজের বয়সী আরো অনেকের। কেউ নৌকা বাইছে। কেউ মাছ ধরছে। অকালবন্যায় ফসলহানির পর বই-খাতা ছেড়ে হাওড়ে নামতে হয়েছে তাদের।
জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, হাওড়বেষ্টিত সুনামগঞ্জেই প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার। এপ্রিলে বন্যার পর গড়ে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. বায়েজিদ আহমদ বলেন, এপ্রিলের বন্যার পর থেকে ১০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে। আমরা তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে ঝরে পড়া বলা যাবে না।
শিক্ষা কর্মকর্তারা ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির কথা বললেও স্থানীয়দের মতে, হারটা আরো বেশি। এলাকার বিভিন্ন ঘাটে গিয়েও দেখা যায়, খেয়া নৌকায় যাত্রী পারাপারে ব্যস্ত বিদ্যালয়গামী বিপুল সংখ্যক শিশু। তাহিরপুর ঘাটের ইঞ্জিন নৌকার চালক সাব্বির আহমদও জানালেন, কাজের জন্য প্রতিদিনই তার কাছে একাধিক শিশু আসে।
সাব্বির আহমদের নৌকায় সহযোগী হিসেবে কাজ করে আরিফ রহমান। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল সে। এখন নৌকাচালকের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। আরিফের ভাষায়, বাবা মারা গেছেন চার বছর আগে। মা বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতেন। নিজেদের জমি থেকে কিছু ধানও পাওয়া যেত। এবার ধানও নেই, মায়ের কাজও নেই। তাই চারজনের সংসারের খাবার জোগাতে আমাকেই কাজে নামতে হয়েছে।
ধর্মপাশার কাউহানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল গণি বলেন, হাওড়ে বন্যার পর বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কিছুটা কমেছে। এদের কেউ কেউ কাজে যোগ দিয়েছে বলে শুনেছি। তাদের আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। বন্যার পানি নেমে গেলে অনেকে বিদ্যালয়ে ফিরবে বলে আশা করি।
সুনামগঞ্জের হাওড়াঞ্চলে ‘আলোর দিশারী’ নামে ভাসমান একটি স্কুল পরিচালনা করছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। এতে মাধ্যমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩২১। গত এপ্রিলের আগাম বন্যার পর থেকে ৪৮ জন শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে ৩৩ জনকে ফিরিয়ে আনে কর্তৃপক্ষ। বাকি ১৫ জন এখনো স্কুলে ফেরেনি। তারা বিভিন্ন কাজে যোগ দিয়েছে বলে জানা গেছে।
সুনামগঞ্জের মতোই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি কমেছে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের হাওড়প্রধান এলাকায়ও। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের বড়লেখা, কুলাউড়া, জুড়ি ও হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির হার সবচেয়ে বেশি।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল আলিম বলেন, বন্যার কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু প্রভাব তো পড়েছেই। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় অনুপস্থিতির হার কিছুটা বেড়েছে।
সরকারি হিসাবে, চলতি বছরের এপ্রিলে দেখা দেয়া বন্যায় দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার— এ ছয় জেলার ৬২ উপজেলার ৫৪১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫১৮টিই প্লাবিত হয়ে পড়ে। এতে মোট ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির ফসলহানি হয়।
এ ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই দ্বিতীয় দফা বন্যার মুখোমুখি হাওড়াঞ্চলের বাসিন্দারা। চলতি বছর দুই দফা বন্যায় বিপর্যস্ত হাওড়াঞ্চলের শিশুরাও এখন জীবিকার সন্ধানে নেমেছে।
বন্যাকবলিত এলাকার এসব শিশুকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আগামীতে সরকারি ছুটিগুলো কমিয়ে এনে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে স্থানীয় সরকারের বড় ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন।
তবে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণে অনেক পরিবারের শিশুদেরই আর বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী। তিনি বলেন, অবকাঠামোগত বড় ধরনের ক্ষতির কারণে বিদ্যালয়গুলো এখন পাঠদান উপযোগী হয়নি। বন্যার পানিতে অনেক শিক্ষার্থীর বই-খাতা হারিয়ে গেছে। আর্থিক ক্ষতির কারণেও অনেক পরিবারের পক্ষে সন্তানের শিক্ষা চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বল্পমেয়াদে শিক্ষার্থীদের হাতে দ্রুত বইপত্র পৌঁছাতে হবে।