২০১০ সালে দেশে পাটজাত মোড়ক বাধ্যতামূলক আইন প্রণয়ন হয়। নতুন আইন পাস হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটজাত মোড়কের বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পান উত্তরবঙ্গের এক তরুণ উদ্যোক্তা। ছোট আকারে পাটকল স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেন তিনি। এজন্য ভারত থেকে পুরনো লুম মেশিন আমদানি করেন। ভারতের একটি পাটকল থেকে কেনা ওই মেশিনে ভর করে ২০১৩ সালে তার পাটকল চালু হয়। প্রথমে কিছুদিন ভালো চললেও এখন প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ে ধুঁকছে তার প্রতিষ্ঠিত পাটপণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি।
২০১০ সালে প্রণয়নের প্রায় দুই বছর পর পাটজাত মোড়ক বাধ্যতামূলক আইন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বেগবান হয়। এদিকে ২০১২ সালে ভারতে পাটকল আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। পাটকলগুলোয় নতুন মেশিন স্থাপনে আর্থিক অনুদান ঘোষণা করে ভারত সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় পাটকলগুলো পুরনো মেশিন বিক্রি করতে থাকে। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগাতে সে সময় অনেক উদ্যোক্তাই ভারতীয় পাটকলের পুরনো মেশিন কিনে তা স্থাপন করেন। আমদানি করা এসব মেশিন কিনে পাটকল মালিকদের অনেকেই এখন প্রতিযোগিতা সক্ষমতার অভাবে ভুগছেন।
সূত্র জানিয়েছে, পুরনো মেশিন বদলে ভারতীয় পাটকলগুলো অত্যাধুনিক মেশিন স্থাপন করেছে। আগের মেশিন একবারে একটি বস্তা উত্পাদন করা গেলে এখন নতুন মেশিনে অধিক সংখ্যক পণ্য উত্পাদন করা যাচ্ছে। আর পুরনো মেশিন স্থাপন করে উত্পাদন শুরু করায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের অনেকের পক্ষেই উত্পাদন ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ধুঁকতে শুরু করেছেন অনেক মিল মালিক।
বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) চেয়ারম্যান শামস-উজ-জোহা বণিক বার্তাকে বলেন, বাজার চাহিদা ভালোভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়া যেসব মালিক বিনিয়োগ করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। ভারত থেকে যেসব মেশিন এসেছে সেগুলোর কার্যকারিতা ঠিক আছে। কিন্তু এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারী প্রতিযোগিতা সক্ষম হয়ে উঠতে পারছেন না। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে তাকে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আধুনিক মেশিন স্থাপনকারী ভারতীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে।
জানা গেছে, ভারত সরকার সে দেশের পাট শিল্পকে আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের জন্য ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর একটি স্কিম চালু করে। পুরনো মেশিন বদলালে স্কিমটির আওতায় পাটকল মালিকদের ২০ শতাংশ অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত সরকার। এ স্কিমের আওতায় ভারতীয় পাটকল মালিকরা পুরনো মেশিন বিক্রি করে নিজেদের কারখানায় নতুন মেশিন প্রতিস্থাপন করেন। ক্রয়কৃত নতুন মেশিনের মূল্যের ২০ শতাংশ তারা সরকারি অনুদান হিসেবে পেয়েছেন। আবার পুরনো মেশিন বিক্রি করে পেয়েছেন নতুন মেশিনের ক্রয়মূল্যের ৩০ শতাংশ। বাকি ৫০ শতাংশ অর্থায়ন হয়েছে স্বল্প সুদ ও সহজ কিস্তিতে ব্যাংকঋণ হিসেবে।
বিজেএমএ সূত্র জানিয়েছে, সরকারি সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভারতীয় পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন হয়েছে। এর ফলে সে দেশে ভালো মানের পাটপণ্যের উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার উত্পাদন খরচ কমে যাওয়ায় ভারতে বহুমুখী পাটপণ্য প্রস্তুতের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে কম দামে পাটপণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের পাটকলগুলো ভারতীয় রফতানিকারকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এর ফলে দেশীয় পাটকলগুলোর লোকসান ও দেনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশের সরকারি ও বেসরকারি পাটকলগুলোর মেশিন ৫০-৬০ বছরের পুরনো। এগুলো দিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দেশের পাট শিল্প। এতে করে পাট খাতে বাড়ছে অপচয়, গুনতে হচ্ছে লোকসান। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ক্ষেত্রে সরকার আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারের সমঝোতা হয়েছে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু বেসরকারি পাটকলগুলোর উদ্যোক্তাদের নিজ সক্ষমতা অনুযায়ী মেশিন আমদানি করে উত্পাদন চালাতে হচ্ছে। পুরনো মেশিনে উত্পাদন চালাতে গিয়ে তাদের অনেকে বাজারে টিকে থাকতে পারছেন না। বর্তমানে বেসরকারি পাটকলগুলোয় ১৫ হাজারেরও বেশি লুম রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি পাটকলগুলোকে দূরদর্শিতার ঘাটতির কারণে সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কারণ পুরনো বা নতুন যেমনই হোক, চাহিদা অনুযায়ী মেশিনের উপযোগিতা বিবেচনা না করে উত্পাদনে যাওয়া উচিত নয়। পাটজাত মোড়ক ব্যবহারে বাধ্যবাধকতার কারণে অনেক উদ্যোক্তাই নতুন বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়েছেন। ঐতিহ্য বিবেচনা করেই অনেকে পাটজাত পণ্য উত্পাদনে মনোযোগী হয়েছেন। কিন্তু তাদের উদ্যোগগুলো টেকসই হতে পারছে না প্রকল্প নকশায় ভুলের কারণে।
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস শহীদ বলেন, যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করেই উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ করা উচিত। এক্ষেত্রে উত্পাদিত পণ্য, বিদ্যমান মেশিনারিজের পুনর্ব্যবহার, বর্তমান কর্মসংস্থানের সুরক্ষা— সব বিবেচনা করেই আধুনিকায়নের কাজ শুরু করতে হবে। কারণ শুধু বিনিয়োগ করলেই হবে না, তার কার্যকারিতাও আগে থেকেই যথাসম্ভব নিশ্চিত করতে হবে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের পাশাপাশি বেসরকারি পাটকলগুলোর আধুনিকায়নের বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে বেসরকারি পাটকল খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনাও শুরু হয়েছে। সেসব আলোচনায় নতুন উদ্যোক্তাদের পাট শিল্পে বিনিয়োগের আগে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাইয়ের সুপারিশের কথা উঠে এসেছে। আর পাটকলে নতুন মেশিন স্থাপন নিশ্চিত করার জন্য ক্রয়মূল্যের ওপর অর্থ অনুদান দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে।
জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দেশে পাট শিল্প-সংশ্লিষ্ট মিলের সংখ্যা ছিল ৭৭। সবগুলোই ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছিল। বর্তমানে সরকারি খাতে পাট শিল্প-সংশ্লিষ্ট কারখানার সংখ্যা মোট ২২। বেসরকারি খাতে বিজেএমএর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৩৪। যার মধ্যে দেশে পাট শিল্পের গোড়াপত্তনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৮টি। সময়মতো পণ্য বহুমুখীকরণের দিকে ঝুঁকতে না পেরে এসব কারখানার অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি পাটকল ও বিজেএমএর অন্তর্ভুক্ত পাটকলগুলোর পাশাপাশি জুট স্পিনিং খাতেও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিজেএসএর (বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন) আওতায় এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮৬টি। এ সংগঠনের বেশির ভাগ সদস্যই নতুন বিনিয়োগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান।
এ প্রসঙ্গে বিজেএমএ সচিব এ. বারিক বলেন, ব্যাংকের দায়দেনা টানতে না পেরেই মূল উদ্যোক্তারা সরে যাচ্ছেন। নতুন যারা উদ্যোগ নিচ্ছেন, তারাও আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ নীতিসহায়তায় ঘাটতির কারণে ভুগছেন। এছাড়া বেসরকারি খাত অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার মতো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনই পায়নি। সরকার বিজেএমসির জন্য ভর্তুকি দিলেও বিজেএমএ পায় না। এ অবস্থায় পুরনো মেশিন আমদানি করে অনেক মালিককেই ভুগতে হচ্ছে।