সরকারি উদ্যোগে স্থাপন করা বিদ্যুৎকেন্দ্র সিরাজগঞ্জের ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট। শুরুতে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৬৮৭ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত এ ব্যয় বেড়ে ১ হাজার ১১৩ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা আর অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় শেষ অবধি অপ্রত্যাশিত অংকে গিয়ে ঠেকেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শুধু ব্যয় নয়, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সময়ও লেগেছে মূল অনুমোদিত সময়ের চেয়ে ১৬৬ শতাংশ বেশি। নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (নওপাজেকো) বাস্তবায়ন করা সিরাজগঞ্জ ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন দেয়া হয় ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এ সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০০৬ সালের জুলাই থেকে ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের ডিপিপি (বিশদ প্রকল্প প্রস্তাবনা) প্রথমবার সংশোধন করে মেয়াদ বাড়িয়ে ধরা হয় ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত। আর ডিপিপির দ্বিতীয় সংশোধনীতে তা আরো বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর করা হয়। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ আরো একবার বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় জুন ২০১৪ সাল।
প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৬৮৭ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য ৪৩৩ কোটি ১৪ লাখ বাকিটা সরকারের অর্থায়ন। তবে ডিপিপি সংশোধনের মাধ্যমে এ ব্যয় ৯৬২ কোটি ২৬ লাখ ২৭ হাজার টাকায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এতে প্রকল্প সাহায্য কমে দাঁড়ায় ৩৮০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ডিপিপি দ্বিতীয়বার সংশোধন করে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ১৪৪ কোটি ৮০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকারের অর্থায়ন ৬৩৮ কোটি ৬৩ লাখ ৭৯ হাজার ও প্রকল্প সাহায্য ৫০৬ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার টাকা।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বণিক বার্তাকে বলেন, কস্ট বেজড ট্যারিফ বিবেচনায় বেসরকারি খাতের চেয়ে সরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ট্যারিফ কম। দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে ডিপিপি করা হয়। এক্ষেত্রে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে পরবর্তীতে বাস্তবায়ন ব্যয় পরিবর্তিত হতে পারে। প্রকল্পের ব্যয় কমানোর পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে তা বাস্তবায়ন করা উচিত। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
প্রকল্পটির কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশগুলো হলো— ১৫০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন ইউনিটের যন্ত্রাংশ সংগ্রহ ও স্থাপন, দুটি গ্যাস বুস্টার সংগ্রহ ও স্থাপন, মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট পূর্তকাজ, স্টেপ আপ ট্রান্সফরমার ও সুইচগিয়ারসহ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও স্থাপন, পাওয়ার ইভ্যাকুয়েশনের জন্য ১ কিলোমিটার ২৩০ কেভি লাইন স্থাপন, অক্সিলারি ডিজেল জেনারেটর সংগ্রহ ও স্থাপন এবং ভবন নির্মাণ।
জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনকে (সিএমসি)। প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল কাজ শুরু হয় ২০১০ সালের অক্টোবরে। ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সর্বশেষ মেয়াদ ধরা হলেও বাণিজ্যিকভাবে এটি জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে ২০১৩ সালের ১৯ এপ্রিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির রেটেড ক্যাপাসিটি ১৫৮
দশমিক ৭ মেগাওয়াট। চাহিদার ভিত্তিতে এটির উৎপাদন হ্রাস বা বৃদ্ধি করা হয়। তবে পিকিং পাওয়ার প্লান্ট হলেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে এটি বেজলোডে চালানো হয়।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকল্প সমাপ্তি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মূল ডিপিপি ২০০৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর অনুমোদন হলেও ঋণচুক্তি কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। পরবর্তীতে ঠিকাদার নিয়োগ হয় ২০১০ সালে। চারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া দুবার প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করা হয়। প্রক্রিয়াগত এ দীর্ঘসূত্রতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। এতে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ পেতেও সময়ক্ষেপণ হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১১৩ কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা, যা মূল অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ৬২ শতাংশ বেশি।
বাস্তবায়নকারী সংস্থা নওপাজেকোর দাবি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধি ও বিভিন্ন খাতে মূল্য সমন্বয়ের কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর প্রকল্পের কাজের পরিধি বৃদ্ধির কারণে ডিপিপি দ্বিতীয়বার সংশোধন করা হয়। এছাড়া বৈদেশিক অর্থায়ন প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা ও দরপত্র মূল্যায়নে জটিলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লেগেছে বেশি।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, দরপত্র মূল্যায়ন কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ। নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে দরপত্রের শর্তও তাদের অনুকূলে রাখা হয়। যন্ত্রাংশ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও প্রভাব কাজ করছে। এতে আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি কাজের মানের ক্ষেত্রেও সমঝোতা করা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবেই এগুলো করা হয়।
উল্লেখ্য, এরই মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর করা হয়েছে। এজন্য ২০১২ সালের আগস্টে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়। চীনের সিএসসি এ প্রকল্পটিরও ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে। এতে ব্যয় হয়েছে ৬৭৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর বাণিজ্যিকভাবে এটির উৎপাদন শুরু হয় ২০১৪ সালের জুলাইয়ে।
দাতা সংস্থার সুপারিশে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠন করা হয় নওপাজেকো। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৭ সালের আগস্টে। ২০১২ সালের নভেম্বরে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে এটি। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ৭২২ মেগাওয়াট।