চার বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্সের সনদ ১৭ মাসে!

Slider শিক্ষা

base_1502998016-raj

বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) থেকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন পায় প্রতিষ্ঠানটি। এর পর একই বছরের এপ্রিলে বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামের অনুমোদন মেলে। সে অনুযায়ী চার বছর মেয়াদি ওই প্রোগ্রামের প্রথম ব্যাচের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালে। অথচ প্রোগ্রাম অনুমোদনের ১৭ মাসের মধ্যেই আবদুল মোতালেব হাওলাদার নামের এক শিক্ষার্থীকে বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির সনদ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

অবৈধ সনদ প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আকস্মিক পরিদর্শনে যায় ইউজিসির একটি  দল। পরিদর্শন শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. আখতার হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি। তদন্তে উঠে আসা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বণিক বার্তাকে বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রসারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়েছে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার আওতায় আনতে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের দেয়া এ সুযোগের অপব্যবহার করছেন কিছু সুবিধাভোগী। তারা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সার্টিফিকেট বিক্রির দোকান বানিয়ে ফেলেছেন। এভাবে চলতে পারে না। এদের লাগাম টেনে ধরা হবে।

রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির অবৈধ সনদ প্রদান বিষয়ে ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ বছর ৫ মাসের মধ্যে কীভাবে চার বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্সের সনদ দেয়া হলো এবং ডিগ্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তি বরিশাল সিটি করপোরেশনে কর্মরত অবস্থায় কীভাবে নিয়মিত ক্লাসে অংশগ্রহণ করলেন, সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। তিনি কমিটির কাছে স্বীকার করেন যে, এ জাতীয় আরো অনেক সনদ ইস্যু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ পর্যন্ত ৮৫ জনকে সনদ দেয়া হয়েছে বলেও কমিটিকে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) সুমন চন্দ্র দাস।

বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ। তার বিরুদ্ধেও অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল আজিজ তার ঢাকাস্থ আবাসিক ফ্ল্যাটের একাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে প্রতি মাসে ৬৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন তিনি, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অর্থ আত্মসাতের শামিল।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন অধ্যাপক আবদুল আজিজ। তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ কিংবা তদন্তের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।

অধ্যাপক আবদুল আজিজ এমন বক্তব্য দিলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্ত কমিটির সঙ্গে সাক্ষাত্ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে

গৃহীত সব অর্থ ফেরত ও ঢাকাস্থ লিয়াজোঁ অফিস বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে কোনো ধরনের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ খুঁজে পায়নি বলে জানিয়েছে ইউজিসির প্রতিনিধি দল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ তলাবিশিষ্ট ভাড়াকৃত ভবনের নিচতলায় গাড়ি মেরামতের গ্যারেজসহ দোকানপাট থাকায় শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।

পরিদর্শনের ঘটনা ও পরিস্থিতি বর্ণনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিদর্শনকালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী উপস্থিত থাকলেও কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল না। ইউজিসি প্রতিনিধি দলের আকস্মিক পরিদর্শন বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রারের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হয়েছে। বিনা নোটিসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও দেখান। এ সময় তাকে অসহায় ও অস্থির মনে হয়। তার কাছে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য চাইলে তিনি সব তথ্য ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে রয়েছে বলে জানান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র তিনটি ল্যাবরেটরি থাকলেও এগুলোয় উল্লেখযোগ্য কোনো যন্ত্রপাতি নেই। টেক্সটাইল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফার্মাসি বিষয়ে প্রোগ্রাম থাকলেও এ বিষয়ক কোনো ল্যাব নেই। সিএসই বিভাগে ১৪টি কম্পিউটার থাকলেও নেই কোনো ইন্টারনেট সংযোগ। ইইই বিভাগে দৈন্যদশায় একটি ল্যাব থাকলেও তা নিয়মিত ব্যবহারের কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি। শ্রেণীকক্ষগুলোয় ধুলাবালি জমে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ক্লাস পরিচালিত হয় না বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা অপর্যাপ্ত এবং পড়ালেখার কোনো অনুকূল পরিবেশ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনেও অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে তদন্ত প্রতিনিধি দল। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ঢাকায় থেকে সব ট্রানস্ক্রিপ্ট ও সার্টিফিকেট স্বাক্ষর করেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ন্যূনতম ল্যাব সুবিধা থাকায় ল্যাবভিত্তিক বিএসসি ইন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি ইন সিএসই ও বি.ফারমা প্রোগ্রামে ২০১৭ সালে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখা ও সুপারিশটির আলোকে একটি বিজ্ঞপ্তি কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশের জন্য ইউজিসির প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে।

আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর অত্যাবশ্যকীয় ধারা ৬, ৯, ১২, ১৪, ২৯, ৩৫, ৪৪ এবং ৪৬-এর অনুসরণ ও প্রতিপালন করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির সাময়িক সনদ কেন বাতিল করা হবে না সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে।

আবদুল মোতালেব হাওলাদারের বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক সনদটি অবৈধ বলে কমিটির কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই অবৈধভাবে গৃহীত সনদ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে বরিশাল সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ করতে পারে।

বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ প্রতি মাসে তার ঢাকাস্থ আবাসিক ফ্ল্যাটের একাংশের ভাড়া হিসাবে বিপুল অংকের টাকা গ্রহণ করায় নৈতিক স্খলনজনিত কারণে ট্রাস্ট অ্যাক্ট ১৮৮২ এবং সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৮৬০-এর আওতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *