বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে দেশ। জেলায় জেলায় প্রকৃতির এই দুর্যোগের সঙ্গে লড়ছে মানুষ। এবার প্রকৃতির খেয়ালি বৈরী আচরণের ঘটনা একের পর এক ঘটছে। পাহাড়ধসে মানুষ মরেছে। হাওর অঞ্চলে অকাল বৃষ্টি, আগাম বন্যা আর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সব ফসল তলিয়ে গেছে। সরকার, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেই দুর্যোগ যেতে না যেতেই ঝড়-টর্নেডো হাওর অঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছে। এখন ২০ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
এরই মধ্যে দেশজুড়ে ধর্ষণের তুফান বয়ে গেছে। ধর্ষকদের হাত থেকে অবুঝ চার বছরের শিশুও রক্ষা পায়নি। পিতার হাতে কন্যা, চাচার হাতে ভাতিজিও না। গোটা সামাজিক, রাজনৈতিক, মূল্যবোধের অবক্ষয় সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে কয়ে আসে না। এতে কারও হাত নেই, সবাই মিলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু মানবসৃষ্ট বিপর্যয় রাজনীতির চোরাপথে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অন্ধকার গলিপথ ধরে যে জাতীয় দুর্যোগ নেমে আসে সেটি রুখা যায় না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব আগাম সতর্ক ও দায়িত্বশীল না হলে সেটি রুখে দেওয়া কঠিন।
আমাদের ৪৬ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাবিধুর ঘটনা ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বাঙালি জাতির ইতিহাসের ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘুমন্ত, নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র খুনিদের রক্তের প্লাবন বয়ে দেওয়া। যে মহান নেতা তার জীবন-যৌবন, আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হারাম করে জেল-জুলুম, নির্যাতন ও ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে একটি ঘুমন্ত জাতিকে স্বাধিকার-স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে ব্যালট বিপ্লবে সাংবিধানিক নেতৃত্ব অর্জন করে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। সেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ড কেবল বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর বলে নিন্দিত আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদের ক্ষমতার উচ্চাভিলাষ ছিল না, সশস্ত্র বাহিনীর বিপথগামী একদল ভাড়াটে খুনির নৃশংসতাই ছিল না, এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত বিশ্বমোড়ল ও তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগী এবং জাতীয় ষড়যন্ত্রের অশুভ ফসল।
এক ব্যক্তি বা তার পরিবারকে সেদিন হত্যা করা হয়নি। এক বিশ্বনন্দিত দুনিয়া কাঁপানো রাজনীতিবিদকেই হত্যা করা হয়নি, একটি নবসৃষ্ট রাষ্ট্রের আদর্শ, তার নেতৃত্ব ও স্বপ্নকেই হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের পথ ধরে অনেক হত্যাকাণ্ড, অনেক প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং ক্ষমতার লড়াই একের পর এক ঘটে গেছে। সামরিক শাসনের কবলে পতিত হয়েছে বাংলাদেশ। সেই সামরিক শাসনের কবল থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে এদেশের ছাত্রসমাজসহ জনতার অংশগ্রহণই ঘটেনি, অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। জেল-জুলুম, নির্যাতন, মামলা, হামলার শিকার হতে হয়েছে। গণতন্ত্র মুক্তির পর ভালো ও মন্দে আমরা কার্যত গণতন্ত্রের দুই নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম দুই শাসনামল উত্তমরূপে পেয়েছিলাম।
বিএনপি-জামায়াতের শাসনামল থেকেই অভিশপ্ত হাওয়া ভবনের শক্তি এবং সেই একাত্তরের পরাজিত শক্তির সক্রিয় হাত আবার এই ভূমিতে ষড়যন্ত্রের নাশকতার সুযোগ পেল। জঙ্গিবাদ, বোমা সন্ত্রাসকবলিত হয়ে উঠল বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের অন্ধকার সমর্থনে একুশের গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা দিনদুপুরে ঘটিয়ে এক জাতীয় নেত্রীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো তার সতীর্থদেরসহ। অলৌকিকভাবে আবারও শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও সেই বিকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ রক্তের প্লাবনে ভেসে গেল।
অন্যদিকে, রাজনীতিতে ’৯০-উত্তর গড়ে ওঠা আস্থা, বিশ্বাস ও সমঝোতার কবর রচিত হলো। অনেক রাজনৈতিক নেতার হত্যাকাণ্ডই ঘটেনি, ১০ ট্রাক অস্ত্রের মতো বড় ধরনের চালান ধরা পড়ল। মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে এই মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হলো। যার কোনোটাই আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের জন্য শুভ হলো না।
কোনো অশুভ চিন্তা বা কর্মকাণ্ড সাংবিধানিকভাবে প্রদত্ত প্রকৃত মালিক জনগণ কখনো করেনি। জনগণ একেকটি ট্র্যাজিক ঘটনার শিকার বা ভুক্তভোগী হয়েছে মাত্র। কিন্তু সব অশুভ চিন্তা ও অশুভ তৎপরতা প্রতিটি ঘটনার নেপথ্যে যারাই ঘটিয়েছেন তারা অগ্রসর, চিন্তাশীল, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বে বা প্রশাসনযন্ত্রের ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে প্রতিটি সামরিক শাসনের পুতুল রাষ্ট্রপতি হয়েছেন বিচারপতি আবু সায়েম থেকে বিচারপতি আহসান উদ্দিন। আবার এটিও সত্য জাতির ক্রান্তিলগ্নে অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সকারের হাল ধরেছেন রাজনীতিবিদ বা সংবিধানের ডাকে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন থেকে বিচারপতি হাবিবুর রহমান পর্যন্ত। কিন্তু গণতন্ত্রের নবযাত্রায় কারাবন্দী ও নির্যাতনের মুখে পতিত সেনাশাসক নিজে পাঁচটি করে ও তার দল ৩৫টি আসন নিয়ে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত হলেও ভোটের লড়াইয়ে তাদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়নি। এটা জাতীয় পার্টির প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা এরশাদের প্রতি কোনো সহানুভূতির বিষয় নয়, এটি সত্য।
বরাবর বলে আসছি, এদেশে একদলীয় শাসন, সামরিক শাসন এবং সেনাসমর্থিত তথাকথিত সুশীলের শাসন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ হাঁটা সুমহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী এই জাতির জীবনে সংসদীয় গণতন্ত্রই একমাত্র গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, একটি কার্যকর সংসদ ও সুশাসন, আইনের শাসন এবং প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ জনগণের প্রত্যাশার জায়গা নিয়েছে। নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ধারায় প্রত্যাবর্তন সময়ের দাবিই নয়, নির্লোভ, গণমুখী, আদর্শিক রাজনীতির পথে রাজনীতিবিদদের হাতে সংসদ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাও মানুষের বহুল আশা ও স্বপ্নের জায়গা।
সম্প্রতি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ঘিরে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কী সরকারি দল, কী বিরোধী দল অনেকেই বিচার বিভাগ নিয়ে লাগামহীন, উন্নাসিক কথাবার্তাই নয়; রীতিমতো গায়ের জোরে বক্তৃতা করছেন। আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ এরকম মুখোমুখি কখনো হয়নি। খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে নির্বাচন শেষ করে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন তার স্বপদে অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির আসনে ফিরে গেছেন। জাতীয় শোক দিবসের একটি আলোচনা ছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে।
এখনো মনে পড়ে আলোচনা শুরুর পর প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ ইসতিয়াক আহমেদ মঞ্চে এসে উঠলেন। বক্তৃতায় তিনি বললেন, আমরা একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি। সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে একটি বৈঠকে যোগ দেওয়ায় এ আলোচনায় আসতে বিলম্ব হলো। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই বিএনপি বিচারপতি নিয়োগ দিতে গিয়ে এই সংকট সৃষ্টি করেছিল। সেই সুপ্রিম কোর্টের সব সিনিয়র আইনজীবী এক হয়ে গিয়েছিলেন। সেনাশাসক এরশাদের জমানায়ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছিলেন।
খালেদা জিয়ার সরকারও সৈয়দ ইসতিয়াক, ড. কামাল হোসেনদের দৃঢ় অবস্থানের সঙ্গে আপস করেছিলেন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করেই বিচারপতি নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছিল। আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ অতীতে এবারের মতো কখনো মুখোমুখি হয়নি। বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমেদ মানিককে নিয়েও সংসদে বিতর্কের ঝড় তুলেছে, সরকারি দলের নেতারাই তুলেছেন। সংসদ সেটি পারে, কিন্তু তার ঢেউ বাইরে গিয়ে আছড়ে পড়ে। মানুষের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাতজন বিচারক ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন। সংবিধানের গার্ডিয়ান হিসেবে অনেকে বলছেন, এ রায়ের মধ্যদিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিচার বিভাগকে বিচারপতি মুর্শেদ জামানায় নিয়ে গেছেন। বিচার বিভাগ যে অনেক স্বাধীন ও ক্ষমতাশালী এ রায়ের মধ্যে তা আমরা টের পাচ্ছি। আমাদের বোবা দর্শক হয়ে থাকাই মঙ্গল। সংসদে এখন ’৭২-এর সেই রাজনীতিবিদ সংসদ সদস্যদের একচ্ছত্র দাপট নেই। রাজনীতিবিদদের হাত ধরে অনেক ব্যবসায়ী নন, অনেক টেন্ডারবাজ, মাদক ব্যবসায়ীও ঢুকে পড়েছেন।
’৭২-এর সংসদ সদস্যদের মর্যাদা মানুষের হৃদয়েই নয় ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সিতেও অনেক উঁচুতে ছিল। সামরিক শাসকদের হাত ধরে নামতে নামতে সেটি এখন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নিচে এসেছে। রাজনীতিবিদরা বা সংসদ সদস্যরা তাদের সেই মর্যাদা এখনো পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।
আমাদের হলো যত বিপদ। আইন প্রণেতাদের নিয়ে কিছু বললে, লিখলে ৫৭ রশিতে হাত বাঁধা পড়ে। বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বললে লিখলে আদালত অবমাননা হয়। সম্পাদকদেরও আদালত অবমাননার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। বসতে পর্যন্ত দেওয়া হয় না। ভুল স্বীকার করে ক্ষমা না চাইলে ফিরে আসতে দেওয়া হয় না। সরকারপক্ষ বলছেন, সংসদ রাষ্ট্রপতিতে নির্বাচিত বা বরখাস্ত করার ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত বিচারপতিদের কেন সংসদ বরখাস্ত করতে পারবে না? বিচার বিভাগ বলছে বা তাদের সমর্থনে সিনিয়র আইনজীবীরা বলছেন, ’৭২ আর ২০১৭ এক নয়। বিচার বিভাগ এখন অনেক স্বাধীন। সেই সংসদ সদস্যরাও এখনকার সংসদে নেই। এ বিতর্ক, এ বিরোধের মুখে সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রথম দায়িত্বহীন মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, যতবার বাতিল হবে, ততবার পাস করবেন। তিনি আরও দ্বম্ভের সঙ্গে বলেছেন, আমরা তাদের চাকরি দেই, তাদের পোদ্দারি চলবে না।
অর্থমন্ত্রীর এ ঔদ্ধত্য বুকে বাজে। আপনার চাকরি কে দেয়, তা ভাবুন। বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্ট কয়েক বছর ধরে অতীতের গৌরব হারিয়েছে। কালো গাউনের মর্যাদা রক্ষাকারী সেসব আইনজীবীর সংখ্যা কমছে। আদালতপাড়ায় হাতাহাতি, মারামারি, পাল্টাপাল্টি মিছিল, সভা, প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মানুষকে ব্যথিত করে। অর্থমন্ত্রী মুহিতই নয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সংসদের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে যে ভাষায় ও ভঙ্গিমায় বক্তৃতা করেছেন তা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। বটবৃক্ষের মতো বঙ্গবন্ধু যখন আলো দিয়েছিলেন, সেই আলোর নিচে দাঁড়িয়ে দলের পক্ষে-বিপক্ষের অনেকেই বড় বড় কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতার আলো দিয়ে রাখলে অনেকেই বড় কথা বলেন। এ ভেংচি এ ভাষা ওয়ান-ইলেভেনের সময় কারও মুখে দেখা যায়নি। এদিকে বিএনপির পার্টি অফিসে বসে রুহুল কবির রিজভী যা খুশি তাই বলছেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আগুনে ঘি ঢেলে বলছেন, সরকার বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছেন তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। রায়ের মন্তব্য নিয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে, রায় তাদের সংক্ষুব্ধ করেছে। এটিই গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্য ভাষা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, শেখ হাসিনাকে বাইরে রেখে নির্বাচনী ষড়যন্ত্র চলছে। জনগণের রক্তে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, জনগণ নয়, বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে বাস করছি।
এক রায়ে বিএনপির কাছে এস কে সিনহা ঈশ্বরের কাছাকাছি চলে গেছেন। আরেক রায়ে খায়রুল হক শয়তান হয়ে গেছেন। অন্যদিকে সরকারি দল এস কে সিনহাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শান্তি কমিটির সদস্য বলতেও ছাড়ছে না। মতিয়া চৌধুরী তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যখন তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তখন কেন এ কথাগুলো বলেননি। সরকারবিরোধীরা সেদিন যে সিনহার বাড়িতে বোমা মারল সেই তিনিই যেন সরকারের চরম শত্রু।
সামগ্রিক পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নীরবতা বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছে। ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছেন। এটা শুভ লক্ষণ। এটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। রায়ের মন্তব্যে তিনবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলা হয়েছে। কিন্তু এককভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে কারও কৃতিত্ব নেই। এটি আওয়ামী লীগকে ক্ষুব্ধ করেছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য এক্সপাঞ্জ করতে। রিভিউ করার চিন্তা করছেন। দীর্ঘ রায় তারা পাঠ করছেন। মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে জনগণের লড়াইয়ে সম্পন্ন হয়েছে, তার ডাকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ ধরে মানুষ জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। এটা মীমাংসিত সত্য। গণতন্ত্রের রাজনীতি জনগণনির্ভর। দাবি আদায়ের পথ রাজপথ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনই ইতিহাস স্বীকৃত সমাধান। পাকিস্তানের মতো বিচার বিভাগের কাঁধে বন্দুক রেখে রাজনৈতিক সমাধান সমর্থনযোগ্য নয়। এদেশের বিচার বিভাগ যেমন পাকিস্তানের বিচার বিভাগ নয়, তেমন লাখো শহীদের রক্তস্নাত এ বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত নয়। রায় নিয়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে এতে আগুনে ঘি ঢেলে ষড়যন্ত্রের অন্ধকার পথ প্রশস্তকরণ আমাদের কাম্য নয়। সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় করে। আমরা আর ওয়ান-ইলেভেন চাই না। ওয়ান-ইলেভেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার পথ ধরে। সেই স্বপ্নে আমাদের অনেকের চিত্ত চাঞ্চল্য হয়েছিল। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পরিণতি দেশ ও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনেনি। গোটা বাংলাদেশ আতঙ্কগ্রস্ত করে ব্যবসায়ীদের থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ হয়ে সাধারণ মানুষকেও নিপীড়ন দিয়েছিল। অপমান, অপদস্ত চরম আকারে করেছিল। বড় ভাই আইন ও তথ্য উপদেষ্টা, ছোট ভাই জীবনে মদ স্পর্শ না করেও মদের মামলায় দেশ ছেড়েছিলেন। দুই নেত্রীসহ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা হয় জেল খেটেছেন নয় দেশ ছেড়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর অনেক অফিসারেরও ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো আখের গুছিয়েছেন। সেই সময় দেখা গেছে, জনগণ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই নেত্রীর সঙ্গেই আছেন। তাই সবার কাছে অনুরোধ, সংযত হোন। রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করুন। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগের ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব এখনই শেষ করুন। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা লালন করে সংবিধান ও আইনকে সমুন্নত রেখে আধুনিক, উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সমঝোতার রাজনীতির দুয়ার খুলুন গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।