বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ওই সময়কার সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ বীর-উত্তম বলেছেন, তিনি ছাড়া সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন সবাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে জানতেন। কিন্তু কেউ তাকে সে বিষয়ে কিছু জানাননি।
শফিউল্লাহ বলেন, ‘১৫ আগস্ট ফজরের নামাজের পরপরই সামরিক গোয়েন্দ বিভাগের (ডিএমআই) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দিন আমার বাসায় এসে বলেন, স্যার, আর্মির কিছু সদস্য ট্যাংক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে গেছে। তখন আমি ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিলকে ব্যাটালিয়ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিই। সেনাবাহিনীর পোশাক পরা লোকদের দেখে বঙ্গবন্ধু আমার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই সবাইকে ফোন করলেও তিনি আমাকে করেননি। পরে খবর পেয়ে আমি তাকে ২০-২৫ বার ফোন করি। এরপর একবার ফোন রিসিভ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শফিউল্লাহ, তোমার বাহিনী আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। কামালকে মনে হয় মেরে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি লোক পাঠাও। ’ আমি তাকে বললাম, ‘স্যার আপনি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যান। এরপর আমি লাইনে থাকলেও তিনি আর কোনো সাড়া দেননি। কিছুক্ষণ পর আমি গুলির শব্দ শুনতে পাই। ’বঙ্গবন্ধু হত্যা-উত্তর ঘটনাবলির প্রত্যক্ষদর্শী শফিউল্লাহ বলেন, শাফায়াতকে ফোন দিয়ে আমি মেজর জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ডাকি। শাফায়াতকে ফোনে নির্দেশনা দিলেও তখনো কোনো খোঁজ না পাওয়ায় আমি আমার অফিসে যাই। এর আগে খালেদ মোশাররফকে বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে বলি। এ সময় জিয়াও আমার সঙ্গে অফিসে আসেন। সকাল ৬টার দিকে খবর পাই যে বঙ্গবন্ধু আর নেই। এ সময় খালেদ মোশাররফ ফোনে জানায়, তাকে ওরা আসতে দিচ্ছে না। আমি বলি, কারা আসতে দিচ্ছে না? এর কিছুক্ষণ পরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মেজর ডালিম কয়েকজন সেনা সদস্য নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় আমার অফিসে আসে। ডালিম সরাসরি আমার রুমে ঢুকে আমার খুব কাছে এসে অস্ত্র তাক করে বলে, ‘প্রেসিডেন্ট আপনাকে যেতে বলেছেন। তখন আমি বলি, ‘বঙ্গবন্ধু আর বেঁচে নেই তাহলে তিনি আমাকে কীভাবে ডেকে পাঠান। ’ ডালিম তখন বলে, ‘এখন খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট। তিনি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। ’ তখন আমি আমার দিকে তাক করা অস্ত্রের নলে হাত দিয়ে বলি, এই অস্ত্র আমি দেখে এবং ব্যবহার করে অভ্যস্ত। কথা বলার জন্য এসে থাকলে অস্ত্র আর অন্য সেনাদের বাইরে রেখে এস। সে বাইরে অস্ত্র রেখে এসে আমাকে যেতে বললে আমি বলি, খন্দকার মোশতাক তোমার প্রেসিডেন্ট হতে পারে, আমার না। তোমরা যা পার করতে পার। আমি কোথাও যাব না। এ কথা বলে আমি তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাইরে এসে আমার গাড়িতে উঠতে যাই। ঠিক এ সময় পেছনে তাকিয়ে দেখি জিয়াউর রহমান ডালিমকে বলছেন, ‘কনগ্রাচুলেশন ডালিম, ওয়েল ডান। এসো আমার গাড়িতে ওঠো। ’ তখন ডালিম বলল, ‘না আমি কোনো জেনারেলের গাড়িতে উঠব না। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। ’ জিয়ার এই কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়ে যাই। তখনই আমার মনে হয় এর মধ্যে তার হাত আছে।
এরপর, শফিউল্লাহ ৪৬ ব্রিগেডের দিকে রওনা দেন। তিনি বলেন, সেখানে গিয়ে দেখি সব কমান্ডার ব্যস্ত। আমার কথা শোনার মতো লোক নাই। এ সময় তারা অস্ত্রের মুখে নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী প্রধানকে নিয়ে আসে। সেখান থেকে আমাদের তিনজনকে অস্ত্রের মুখে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে দেখি খন্দকার মোশতাক বসে আছেন, তার পাশে দাঁড়িয়ে তাহের উদ্দিন ঠাকুর। এরপর আমাদের পাশের একটি কামরায় নিয়ে গিয়ে সরকারকে সমর্থন দিয়েছি এরকম একটা লেখা নিয়ে এসে পড়তে বলে। এরপর সেটা আমাদের পড়তে হয়েছে, যা- তারা রেকর্ড করে প্রচার করেছে। মার্শাল ল’ নিয়ে আলোচনা এবং সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে কে এম শফিউল্লাহ বলেন, মার্শাল ল’ হবে কি না এসব নিয়ে আলোচনা চলছিল। আমি তখন বঙ্গভবনে। সে সময় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারী লে. কর্নেল রশিদ এসে আমার কাছে বসে। আমি তাকে বলি, আচ্ছা রশিদ, বঙ্গবন্ধুর হত্যার এই পরিকল্পনা আমি ছাড়া আর কে কে জানে না। তখন রশিদ বলে, ‘স্যার, আপনি ছাড়া সবাই জানেন। আমরা প্রথম খালেদ মোশাররফ স্যারকে তার অফিসে গিয়ে বলেছিলাম। তিনি আমাদের গালিগালাজ করে অফিস থেকে বের করে দেন। ’ তাহলে আমায় বলনি কেন— আমি এ কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘স্যার, রোজার ঈদের পর আপনার বাসায় সব সেনা সদস্যদের সঙ্গে আমিও সস্ত্রীক দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন আপনাকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু সাহস পাইনি। ’ শফিউল্লাহ বলেন, খালেদ মোশাররফের অফিস আর আমার অফিসের দূরত্ব ২০ গজেরও কম। অথচ তিনি আমায় কিছুই জানালেন না।
শফিউল্লাহ বলেন, কিছু মানুষ তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর মধ্যে একজন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের শেখ সেলিম। তিনি বলেন, শেখ সেলিম ভয়াবহভাবে প্রশ্ন তুলে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চান যে, আমি দোষী। তিনি একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে আঙ্গুল তুলে আমায় বলেন, আপনি কেন বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলেন? আমি যেহেতু তাকে বাড়ির ভিতর রক্ষা করতে পারছি না, তাহলে তিনি বাইরে বেরিয়ে গেলে বেঁচে যেতে পারতেন যেভাবে শেখ সেলিম বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাক মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন গোয়েন্দাদের মাধ্যমে (পাকিস্তানের সঙ্গে) শিথিল কনফেডারেশন করার চেষ্টা করছিলেন। ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন শেখ মণি। যেহেতু শেখ মণি ছিলেন আমি যদি বলি শেখ সেলিমও ছিলেন তাহলে ভুল বলব না। কারণ যেদিন সকালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় তখন শেখ সেলিম সেদিন মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। শেখ সেলিম বলেন যে, তিনি তার ভাই ও ভাবীকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা পুরো অসত্য কথা। তিনি কেন আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে গেলেন! আমেরিকা কি বঙ্গবন্ধুর খুব বন্ধু ছিল? খন্দকার মোশতাক আমেরিকান অ্যাম্বাসির সঙ্গে মিলে এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছিলেন। শফিউল্লাহ বলেন, ‘আমি সেনাবাহিনীর প্রধান থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু হত্যা হওয়ায় অনুতপ্ত বোধকরি। কারণ তিনিই আমাকে ওই পদটি দিয়েছিলেন।