দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য গতিশীল করতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নৌ-প্রটোকল সই হয়েছে বেশ আগেই। তবে পাঁচ বছর পর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয় ২০১৫ সালে। মাশুল নির্ধারণের পর এ নৌ-প্রটোকল ব্যবহার করে বাংলাদেশ আয় করেছে প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে ভারতের আয় ছিল শূন্য।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মাশুল নির্ধারণের পর নৌ-প্রটোকলের আওতায় ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নেয়া শুরু করে। মাশুল নির্ধারণের পর ভারত ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নিলেও একটিও ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নেয়নি বাংলাদেশ। নৌ-প্রটোকলের আওতায় ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি হলেও হয়নি কোনো রফতানি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশী ও ভারতীয় নৌযান দিয়ে মোট ২২ লাখ ৫৯ হাজার ৬৫৪ টন পণ্য পরিবহন হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশী নৌযান দিয়ে পণ্য পরিবহন হয় ২২ লাখ ৫০ হাজার ৯৭৪ টন। আর ভারতীয় নৌযান দিয়ে পণ্য পরিবহন হয়েছে ৮ হাজার ৬৮০ টন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪৯৯ টন পণ্য ট্রানজিটে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশী নৌযান। পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশী নৌযানের ভাড়া বাবদ আয় হয়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৭৬ হাজার ৯৬০ টাকা। আর ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের টনপ্রতি ১৯২ দশমিক ২২ টাকা করে আয় হয়েছে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৭৯৭ দশমিক ৭৪ টাকা। সবমিলে নৌ-প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশের আয় হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪১ হাজার ৭৫৭ দশমিক ৭৮ টাকা। এছাড়া ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশের নৌ-রুট সংরক্ষণের জন্য প্রতি বছর ভারত ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করে আসছে।
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় ও ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান গালফ ওরিয়েন্ট সিওয়েজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাহফুজ হামিদ বলেন, ভারত যে ১ টাকাও আয় করেনি, তা বলা যাবে না। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতীয় নৌযান দিয়ে যে ৮ হাজার ৬৮০ টন পণ্য পরিবহন হয়েছে, তাতে আনুমানিক আটটি কনটেইনার ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। আর প্রতি কনটেইনারের জন্য দিনপ্রতি ৫০০ টাকার মতো খরচ রয়েছে, যা ভারতের আয় হিসেবে গণ্য হবে।
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কার্গো পরিবহন কম হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমত. আশুগঞ্জ থেকে সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা খুবই খারাপ। দ্বিতীয়ত. আশুগঞ্জ বন্দরে আমাদের কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। আর তৃতীয়ত. যারা মূলত ভারতের পশ্চিম অংশ থেকে পূর্বে পণ্য পরিবহন করেন, তাদের সঙ্গে এখনো বাংলাদেশের যোগাযোগ ঘটেনি। ফলে এখান থেকে আমরা কাঙ্ক্ষিত কার্গো পাই না। আর বাংলাদেশ থেকে এখনো নৌ-প্রটোকল ব্যবহার করে পণ্য রফতানি
করা হয়নি।
বাংলাদেশ কেন এখনো ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় পণ্য পরিবহন করেনি? এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, তৃতীয় দেশের ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের বিষয়ে ঢাকা-দিল্লি ঐকমত্য থাকলেও পদ্ধতিগত কিছু জটিলতা থেকে গেছে। পণ্য পরিবহন নিয়ে এখনো কোনো মডিউল তৈরি করেনি ভারত। ফলে চুক্তির পরও ভারতের কাছ থেকে তৃতীয় দেশে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। বর্তমানে সীমান্তের ২০০ গজ পর্যন্ত প্রবেশ করে বাংলাদেশী ট্রাকগুলো পণ্য নামাতে পারে। তবে সেটা তাদের কাস্টমসের সীমানার মধ্যে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্য চুক্তির আওতায় দুই দেশের মধ্যে নৌ-প্রটোকল স্বাক্ষর হয়। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিতে যেহেতু তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের সুযোগ রাখা হয়েছে, সে অনুযায়ী নৌ-প্রটোকল ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি সংযোগ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজ ও ভারতের নদী ও সড়কপথ ব্যবহার করে নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, চীন ও মিয়ানমারে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক যাতে বাংলাবান্ধা দিয়ে নেপাল ও ভুটান যেতে পারে, সেজন্য ভারতের কাছে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে এর হালনাগাদ তথ্য এ মুহূর্তে জানা নেই।
১৯৭২ সালে বাণিজ্য চুক্তির আওতায় প্রথম নৌ-প্রটোকল সই করে বাংলাদেশ। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এ চুক্তির কোনো সুযোগ নেয়নি বাংলাদেশ ও ভারত। সে সময় চুক্তিটি এক বছর এবং পরবর্তীতে দুই বছর মেয়াদি ছিল। এরপর প্রটোকলটি দুই বছরের জন্য ২০১২ সালে নবায়ন করা হয়। তবে ২০১৩ সালে বাণিজ্য চুক্তির মেয়াদ তিন বছর করা হয়। সেই সঙ্গে এ চুক্তিও তিন বছর মেয়াদি হয়ে যায়, যার কারণে তা ২০১৫ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আর একই বছরের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে মেয়াদ পাঁচ বছর পরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধির শর্ত রেখে চুক্তিটি সই করে ঢাকা-দিল্লি। সর্বশেষ সই করা প্রটোকল অনুযায়ী, এক দেশের অন্য দেশের ভূমি ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর পণ্য পরিবহনের উপায় রাখা হয়েছে আন্তঃদেশীয়, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে।