‘আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতায় নিরুত্সাহিত হচ্ছে বিনিয়োগ। প্রকল্প বাস্তবায়নে একই ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি ও স্বচ্ছতার ঘাটতি হতাশ করে তুলছে আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বারবার বদলির কারণে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নও হচ্ছে না সময়মতো।’ বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করেছে ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেডস রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর)।
অনেকটা একই ধরনের কথা উঠে এসেছিল মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদের বক্তব্যেও। চলতি বছরেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-বিষয়ক এক চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আয়োজিত এক সভায় এ অভিমত ব্যক্ত করে মার্কিন প্রতিনিধি দল। ওই সভায় বাংলাদেশে ব্যবসার প্রক্রিয়া সহজ করে তোলার বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়। একই সঙ্গে জানানো হয়, দেশে বিনিয়োগের জন্য মার্কিন অনেক প্রতিষ্ঠানই আগ্রহী কিন্তু বাংলাদেশের বিনিয়োগের প্রক্রিয়াগুলো বেশ কঠিন। এসব প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
ইউএসটিআরের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘২০১৭ ন্যাশনাল ট্রেড এস্টিমেট রিপোর্ট অন ফরেন ট্রেড ব্যারিয়ার্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক-অশুল্ক বাধাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এছাড়া অন্য যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক রয়েছে, সেগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিবন্ধকগুলোও প্রতিবেদনে উঠে আসে। প্রতিবেদনে ইউএসটিআর বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ-সংশ্লিষ্ট যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, সেগুলো হলো— আমদানি নীতি, শুল্ক-অশুল্ক পদক্ষেপ, আমদানি অনুমোদন, নিবন্ধন সনদ, সরকারি ক্রয়, বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদের সুরক্ষা, সেবা, টেলিযোগাযোগ, বীমা ইত্যাদি। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ কার্যক্রম সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে মোটাদাগে প্রক্রিয়াগত অস্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক অদক্ষতার ওপরই গুরুত্ব দেয়া হয়।
প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী, আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিরুত্সাহিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের একই ধরনের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকলেও প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতার ঘাটতির কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের হতাশই হতে হচ্ছে। অন্যদিকে প্রকল্পের সময়মতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঊর্ধ্বতন ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বারবার বদলি করার কারণে।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রতিবন্ধক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আমেরিকান চেম্বার অব কর্মাস ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সহসভাপতি শওকত আলী সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতিবেদনে যতটা বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা এত বেশি নয়। বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। কারণ এসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত কিছু জটিলতা রয়েছে। ব্যবসায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া সহজতর করতে সরকারি সংস্থাগুলো বিশেষ করে বিআইডিএ যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে এ-সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো অনেকটাই কমে আসবে।’
ইউএসটিআরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী কর্মীদের অর্থ প্রত্যাবাসন জটিলতা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এতে অভিযোগ তোলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়া বেশ কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। এছাড়া প্রতিবেদনে রাজনৈতিক পরিচয়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদাবাজিসহ জমি বিরোধ, দুর্নীতির মতো বিষয়গুলোর ওপরও আলোকপাত করা হয়। অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও শিল্প সম্পর্কের মতো বিষয়গুলোর কারণেও বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নিরুত্সাহিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। রানা প্লাজা ধসে প্রাণহানির পর শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় কোনো অর্থবহ অগ্রগতি হয়নি বলেও মনে করছে ইউএসটিআর।
জানা গেছে, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতামূলক চুক্তি টিকফার তৃতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও ইউএসটিআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে আসে। বৈঠকে বাংলাদেশের দরপত্র প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা প্রয়োজন বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অভিমত দেয়া হয়।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট ওই সময় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্য ঘাটতি কমানো আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। আমরা বাংলাদেশে সহজে ব্যবসা করতে চাই। এক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছি আমরা।’
এ বিষয়ে বিআইডিএর নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘আমরা খুব আন্তরিকভাবে এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ব্যবসা প্রক্রিয়া সহজ করতে আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছি।’