মাদকসংক্রান্ত অপরাধ অজামিনযোগ্য এবং এই অপরাধের নেপথ্যে থাকা অর্থায়নকারী ও রাঘববোয়ালদের শাস্তির জন্য আইনে সুনির্দিষ্ট ধারা সংযোজন করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার।
নতুন আইনে মাদক ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত সম্পত্তি বা টাকা বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি কারও বিরুদ্ধে যখন মাদক মামলা চলবে, তখন তাঁর ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ রাখারও বিধান রাখা হচ্ছে। যাঁর নাম মাদকাসক্তের তালিকায় থাকবে বা মাদক মামলায় যিনি সাজা পাবেন, তাঁকে যানবাহনের চালকের বা অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হবে না।
শিল্প-কারখানায় ও ওষুধ উৎপাদনে মাদকদ্রব্য ব্যবহারে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। কোনো চিকিৎসক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের লিখিত অনুমোদন ছাড়া ব্যবস্থাপত্রে কোনো মাদকদ্রব্য ওষুধ হিসেবে দিতে পারবেন না।
অংশীদারদের বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা না বলে চিকিৎসার অংশকে গুরুত্ব না দিয়ে আইনের নানা দিক নিয়ে সমালোচনা করেছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, মাদকাসক্ত রোগীদের বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাকে বাদ দিয়ে চিকিৎসক নন—এমন ব্যক্তিদের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মাদকাসক্তি চিকিৎসার বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৭৫ শতাংশ পরিবর্তন করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৭ নামে করা হয়েছে। আইনে নতুন সাতটি ধারা ও ২৮টি সংজ্ঞা সংযোজিত করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক শাস্তি নিশ্চিত করতে কিছু ধারা ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় আনা হয়েছে। ইয়াবাসহ নতুন অনেক মাদকদ্রব্যের বিষয় আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আইনে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা সিসা বার বন্ধের কথা বলা হয়েছে। আইন নতুনভাবে সব মাদকের ওপর শুল্ক ধার্য করার কথা বলা হয়েছে এবং অপরাধের ধরন এই মাদকের পরিমাণ বিবেচনা করে শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
নতুন আইন করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো আইনে ইয়াবা, সিসাসহ বিভিন্ন মাদকের ব্যবহারে কী শাস্তি হবে, তা উল্লেখ ছিল না। চিকিৎসা, শিল্প-কারখানার বিভিন্ন কাজে মাদকের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারকারীর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে কিছু বলা ছিল না। এখন অর্থ জোগানদাতা, পৃষ্ঠপোষক, মদদদাতা, সেবনকারী, বহনকারীর অপরাধভেদে শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড ও এক কোটি জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এলে সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক, সচিব, পরিচালক বা কর্মকর্তাদের দায়ী করা হবে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে ডোপ টেস্টের বিধানও রাখা হয়েছে নতুন আইনে।
অর্থ জোগানদারকে শাস্তি
মাদকে অর্থ বিনিয়োগ, সরবরাহ, মদদ দিলে, পৃষ্ঠপোষকতা করলে বা প্ররোচনা দিলে অপরাধের মাত্রানুযায়ী দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এক কোটি টাকা জরিমানা দিতে হবে। মাদক অপরাধ দমনকাজে নিয়োজিত কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যকে তাঁর দায়িত্ব পালনকালে কোনো ব্যক্তি কোনোভাবে অসহযোগিতা করলে তাঁকেও শাস্তির আওতায় আনা হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আটক কোনো ব্যক্তি যদি অবৈধ অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহে লিপ্ত থাকেন, এবং তাঁর ব্যাংক হিসাব বা আয়কর বা সম্পদকর সম্পর্কীয় রেকর্ডপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। তাহলে মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।
সনদ ছাড়া চলবে না নিরাময়কেন্দ্র
সনদ ছাড়া কোনো ব্যক্তি মাদকাসক্তির পরামর্শ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন না। এই আইনের বাইরে কেউ সনদ না নিয়ে নিরাময়কেন্দ্র পরিচালনা করলে তাঁর জেল-জরিমানা করা হবে। এ ছাড়া লাইসেন্স নেই—এমন কারও কাছে যদি মাদকদ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহারযোগ্য কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়, তবে সর্বোচ্চ ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। অন্যদিকে, সন্দেহ করার যুক্তিসংগত কোনো কারণ না থাকলেও তল্লাশির নামে কোনো স্থানে প্রবেশ করলে, অযথা হয়রানিমূলকভাবে সম্পদ আটক করলে বা গ্রেপ্তার করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে এক বছরের সাজা দেওয়া হবে।
মাদকাসক্তের চিকিৎসা
যদি সরকার মনে করে বা কোনো কর্মকর্তা জানতে পারেন যে কেউ মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে প্রকৃতিস্থ, তবে তাঁকে চিকিৎসা করার নির্দেশ দিতে নোটিশ দেবেন এবং সাত দিনের মধ্যে চিকিৎসা করাতে হবে। অভিভাবককে নোটিশ দিতে হবে। অভিভাবকে খুঁজে না পেলে নিজেরাই সরকারি মাদক নিরাময়কেন্দ্রে পাঠাবেন। এই ব্যয় অভিভাবকে বহন করতে হবে। অভিভাবক না পাওয়া গেরে সরকার বিধি অনুযায়ী করবে। মাদক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রতিটি জেলায় প্রয়োজন অনুযায়ী এক বা একাধিক মাদক আদালত করা হবে।
একই অপরাধ বারবার করলে শাস্তি দ্বিগুণ
মাদকসংক্রান্ত বিভিন্ন রকম অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হওয়ার পর পুনরায় ওই অপরাধ করলে কমপক্ষে ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা অর্থ দণ্ড হবে। অ্যালকোহল খেয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জনগণের শান্তি বিনষ্ট করলে এক বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কোনো ব্যক্তি বা তাঁর দখল করা স্থানে মাদক উৎপাদনে ব্যবহার করা কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া গেলে দুই বছরের সাজা হবে। আদালতে কেউ মাদকাসক্ত বলে প্রমাণিত হলে বা তিনি চিকিৎসা নিতে চাইলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতা বাড়ছে, সিসা বার বন্ধের ধারা
বিদ্যমান আইনে সব ধরনের মাদকদ্রব্য এবং সব ধরনের অপরাধ ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করার ব্যবস্থা ছিল না। নতুন আইনে অপরাধের লঘু-গুরু শ্রেণি পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে তাৎক্ষণিক ও কার্যকরভাবে মাদক অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতা বাড়ানো হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, সিসা বারের অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রম নৈতিক অবক্ষয়সহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ জন্য এটা বন্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে কোনো মাদক আমদানি হলে বা উৎপাদিত হলে তা মাদকদ্রব্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার বিধান করা হয়েছে।
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়ার সমালোচনা করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ও অধ্যাপক ফারুক আলম বলেন, পুরোনো আইনটির প্রয়োজনীয় সংস্কার তো হয়নি, বরং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারা, বিধি ও দফা যুক্ত করে মাদকাসক্ত রোগীদের বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাকে বাদ দিয়ে চিকিৎসক নন এমন ব্যক্তিদের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, মহাপরিচালকের লিখিত অনুমোদন ছাড়া কোনো চিকিৎসক কোনো মাদকদ্রব্য ওষুধ হিসেবে ব্যবস্থাপত্র দিতে পারবেন না, যা বাস্তবসম্মত নয় এবং রোগ চিকিৎসার মূলনীতি ও মানবাধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত করবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বলেন, মাদকাসক্তের চিকিৎসায় বিএমডিসি নিবন্ধনযুক্ত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও অন্য চিকিৎসকদের কোনো অতিরিক্ত সনদের প্রয়োজন হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, যেহেতু মাদকাসক্তি একটি রোগ, কোনো অপরাধ নয়, তাই মাদকাসক্তি রোগের চিকিৎসায় ‘মাদকাসক্তি চিকিৎসাকেন্দ্র’, ‘পরামর্শ কেন্দ্র’, ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’-এর লাইসেন্স এবং তত্ত্বাবধান অবশ্যই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন হওয়া প্রয়োজন।
নতুন আইন ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সমালোচনার বিষয়ে আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, আইন ছাড়া কোনো অপরাধীকেই যেমন বিচারের আওতায় আনা যাবে না—এটা ঠিক, আবার আইনে সঠিকভাবে প্রয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিতে হবে। মাদকসেবীদের অপরাধী ভাবা যাবে না, তাদের অসুস্থ বিবেচনা করেই আইনের বিধিবিধান করতে হবে।