পুরান ঢাকার দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আট আসামির মধ্যে রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদারের সাজা বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। এ ছাড়া চারজনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও বাকি দুজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
এই মামলার আপিল, জেল আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে গতকাল বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস এবং বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়। বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৩ আসামির মধ্যে যে দুজন আপিল করেছিলেন, তারা হাই কোর্টে খালাস পেয়েছেন। পলাতক থাকা বাকি ১১ জনের বিষয়ে হাই কোর্ট কোনো মন্তব্য করেনি। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে রাজধানীর বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে বিশ্বজিেক প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ কর্মীর মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক। নিম্ন আদালতের রায়ের পর এ মামলার ডেথ রেফারেন্স হাই কোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামিপক্ষ আপিল করে। পরে হাই কোর্টে আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আটজনের মধ্যে শাকিল ও রাজনের সাজা বহাল রাখার পাশাপাশি মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন ও মীর মোহাম্মদ নূরে আলম লিমনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে হাই কোর্ট। তবে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুই আসামি সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিয়াকে খালাস দিয়েছে হাই কোর্ট। এ ছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত গোলাম মোস্তফা এবং এ এইচ এম কিবরিয়া হাই কোর্টে খালাস পেয়েছেন। আসামিদের মধ্যে রাজন ও লিমন পলাতক। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত যে ১১ আসামির বিষয়ে হাই কোর্ট কোনো মন্তব্য করেনি তারা হলেন— খন্দকার মো. ইউনুস আলী ইউনুস, তারিক বিন জহুর তমাল, মো. আলাউদ্দিন, মো. ওবায়দুল কাদের তাহসিন, ইমরান হোসেন ইমরান, আজিজুর রহমান আজিজ, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, মোহাম্মদ কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন। বিশ্বজিতের লাশের সুরতহাল করার ক্ষেত্রে সূত্রাপুর থানার এসআই জাহিদুল হকের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কি না- সে বিষয়ে তদন্ত করে পুলিশের মহাপরিদর্শককে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। আর ময়নাতদন্ত করার ক্ষেত্রে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. মাহফুজুর রহমানের কোনো গাফিলতি ছিল কি না- তা তদন্ত করে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এই আদেশ ঠিকমতো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না- সে বিষয়ে সময়ে সময়ে প্রতিবেদন দিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে দায়িত্ব দিয়েছে হাই কোর্ট। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, এস এম শাহজাহান, লুত্ফর রহমান মণ্ডল, সৈয়দ আলী মোকাররম, সৈয়দ শাহ আলম, মো. আবদুস সালাম, মো. ইসা, সৈয়দ মাহমুদুল আহসান। পলাতক আসামিদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মোমতাজ বেগম।
বিস্মিত পরিবার : বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আট আসামীর ছয়জনই আপিলে রেহাই পাওয়া বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশ্বজিৎ দাসের পরিবার। রায় শোনর পর বিশ্বজিতের বাবা অনন্দ কুমার দাস বলেন, ‘আমরা খুব দুঃখ পেয়েছি। ’ ভাই উত্তম কুমার দাসের বক্তব্য, ‘আটজন মৃত্যুদণ্ডের আসামীর দুজনই খালাস পেল! এটা কী করে সম্ভব?’ শরীয়তপুর নড়িয়া সড়কের পাশে মশুরা গ্রাম। ওই গ্রামের ঘোষ পাড়ায় বিশ্বজিতের পরিবারের বসবাস। বসত ঘরের পাশে উঠানের এক কোনে বিশ্বজিতের স্বজনরা তৈরি করেছে তার একটি প্রতিকৃতি। পাথরের তৈরি প্রতিকৃতিটি ঘিরেই তার মা কল্পনা রানি ও বাবা অলন্ত দাস বেঁচে আছেন। বিশ্বজিতের খেলার ব্যাট, ছবি, ব্যবহারের জিনিসের মধ্যেই খুজে ফেরেন তার স্মৃতি। মা কল্পনা রানি বলেন, ‘প্রকাশ্যে ১০-১২ জন মানুষ আমার ছেলেটাকে কুপিয়ে হত্যা করল। ছেলেটা বাঁচার জন্য কতইনা আকুতি করেছিল,পাষণ্ডরা দানবের মত কুপিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। তাদের ছবি দেশের পত্রিকা টেলিভিশনে প্রকাশিত হল। তারপরও তাদের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করা হল? তাদের খালাস দিতে হল? এ রায় মানিনা। পুনরায় বিচার দাবি করছি। ’ অন্তদাস ও কল্পনা রানি দাস উভয়েই বলেন, ‘আশায় বুক বেধে ছিলাম- অপরাধীদের শাস্তি বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু এখন কি হল? তাদের সাজা কমল, খালাস পেল। আমরা এ রায় মানিনা। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের চাওয়া বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা যেন পার পেয়ে না যায়।