নতুন বিতর্ক। ইস্যু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়। এ রায় ঘিরে আলোচনা-পর্যালোচনা। ক্ষোভ-হতাশা। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। রায়কে দুঃসময়ে আশার আলো হিসেবে দেখছে বিএনপি। রায়ের পর সরকারের পদত্যাগও দাবি করেছেন দলটির নেতারা। যদিও সরকারের তরফে এ রায়ের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। ক্ষোভও প্রকাশ পেয়েছে কারও কারও বক্তব্যে। রায় নিয়ে শুক্রবার অনেকটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বলেছেন, আদালত যতোবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে ততোবারই পাস করা হবে। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য ভয়ঙ্কর এবং তা আদালত অবমাননার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আইনমমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এদিকে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে আইন বিশেষজ্ঞদের মাঝেও। আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই রায়কে যুগান্তকারী উল্লেখ করলেও রায়ে নাখোশ সরকার পক্ষের আইনজীবীরা। সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী ষোড়শ সংশোধনী আবার পাস করার কথা বললেও এ সংশোধনী বাতিল চেয়ে রিট করার আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানিয়েছেন, সরকার চাইলেই আর তা করতে পারবে না। রায় মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
গত ১লা আগস্ট বিচারপতিদের অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ সাত বিচারপতির স্বাক্ষরের পর ৭৯৯ পৃষ্ঠার এ রায়ে উঠে এসেছে দেশের নির্বাচন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, জাতীয় সংসদ এর পরিস্থিতি। রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশের রাজনীতিতে ‘আমি’ ও ‘আমিত্বে’র সংস্কৃতির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি সত্যিই জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই তাহলে এই আমিত্বর আসক্তি, আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে। এই আমিত্ব হলো কেবল এক ব্যক্তি বা একজন মানুষ সবকিছুই করতে পারেন এমন ভাবনা’। রায়ে বলা হয়, ‘সংসদ যদি যথেষ্ট পরিপক্ষতা অর্জন না করে তাহলে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত করা হবে একটি আত্মঘাতী উদ্যোগ’। ভারসাম্যের অভাবে সরকার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে বলেও মত আসে রায়ের পর্যবেক্ষণে।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর শুক্রবার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সিনিয়র মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। রায়ের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা এসেম্বলিতে আবার পাস করব, এই আইনটা। এই কনস্টিটিউশনাল এমেন্ডমেন্টটা আমরা আবার পাস করবো এবং অনবরত করতে থাকব। দেখি জুডিসিয়ারি কতদূর যায়। বিকজ জুডিসিয়ারির পজিশন আমার মতে আনটেনাবল (অসমর্থনযোগ্য)। মানুষের প্রতিনিধিদের ওপরে তারা খোদকারি করবে? তাদের আমরা চাকরি দেই।
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের জবাবে গতকাল বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, সরকার বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামলে পরাজিত হবে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ভয়ঙ্কর এবং তা আদালত অবমাননার শামিল উল্লেখ করে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রমাণ করে, সুপ্রিম কোর্ট বা আমাদের উচ্চআদালত বা বিচার বিভাগের প্রতি তাদের কোন আস্থা নেই। তারা বিচারবিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। এখন সরকার যদি মনে করে- তারা বিচারবিভাগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবেন। তাহলে আমি বলতে চাই যে, সেই প্রতিযোগিতায় আপনারা পরাজিত হবেন। কারণ যারাই বিচারবিভাগের উপর হাত দিয়েছে, সেই হাত পুড়ে যায়। বিচারবিভাগ সারভাইভ করে যায়, পার্লামেন্ট সারভাইভ করতে পারে না, সরকারও সারভাইভ করতে পারে না। সরকার পরিবর্তন হতে পারে, পার্লামেন্টের নতুন নির্বাচন হতে পারে কিন্তু এই বিচারবিভাগের অস্তিত্ব, ইজ্জত-সম্মান, ডিগনিটি সেটা সবসময় থেকেছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে নাগরিক ফোরামের ‘নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন: প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য’- শীর্ষক আলোচনা সভায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, এই রায় শুধু ঐতিহাসিক নয়, এই রায় দেশের ১৬ কোটি মানুষের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এমন কোনো বিষয় নেই যার প্রতিফলন হয়নি, জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভ-দুঃখ-অভিযোগ আছে সেগুলোর প্রতিফলন ঘটেনি। এই রায়কে জাতীয় দলিল বলে আমরা আখ্যায়িত করতে পারি। সুপ্রিম কোর্টের ৭ জন বিচারপতির সর্বসম্মতিক্রমে এই রায় দিয়েছেন, আমিসহ দেশের সকলে তাদেরকে সালাম জানাই। সরকারকে সর্তক করে দিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ?বলেন, এই রায়কে সমুন্নত রাখতে হবে। যারা এই রায় অবমূল্যায়ন করবেন, সরকার যদি সেই পথে আরেকবার সংশোধন করতে চান তাহলে তারা ভুল করবেন। তাতে এই সরকারের পতন আরও দ্রুত গতিতে হবে বলে আমি মনে করি।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শনিবার সিলেটের আদালতপাড়ায় সাংবাদিকদের বলেন, অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন, তা অন্তঃসারশূন্য, সংবিধান ও আদালত পরিপন্থি। সরকার চাইলেও এ বিষয়ে নতুন কোনো আইন করতে পারবে না। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিটকারী এ আইনজীবী বলেন, এটা চাইলেও বদলানো যাবে না। গত ৪৬ বছরের ইতিহাসে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের এমন কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। এটা মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সংবিধান মানলে রায় মানতে হবে। তবে বয়স বিবেচনায় অর্থমন্ত্রীর ভুল ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে চান এই আইনজীবী।
রায় নিয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের জবাবে গতকাল আওয়ামী লীগ সাধরণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কেউ কেউ সুপ্রিম কোর্টের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় মহাখুশি। এরা এভাবেই খুশি হয়। তারা আশার আলো দেখছে। তাদের অন্য ইস্যু মরে গেছে, এই আশার আলো অচিরেই নিভে যাবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আসুন। শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত শেখ কামালের জন্মদিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য বার্ধক্যজনিত বা ক্ষমতা হারানোর হতাশার বিকার। তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। সুতরাং তার বক্তব্য সরকারেরই বক্তব্য। এমনিতে এদেশে গণতন্ত্র রুগ্ণ অবস্থা, মৃতপ্রায়; সেখানে অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যে একটা অশুভ ইঙ্গিত বহন করছে। এর মধ্যদিয়ে আদালতের প্রতি ক্ষমতাসীনদের অশ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটেছে। তিনি বলেন, আদালতের রায় নিয়ে মন্ত্রীর এই ধরনের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে আদালত অবমাননার শামিল ও আইনের শাসনের প্রতি চরম ধৃষ্টতা।