যৌন উত্তেজক ওষুধের ছড়াছড়ি আর অবাধ ব্যবহারের কারণেই দেশে যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ নানা বর্বরতার ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেসব ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট যৌন উত্তেজনায় কিছু মানুষ নানা উন্মত্ত কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। ঔষধ অধিদফতরের খামখেয়ালিপনায় দেশের বৈধ-অবৈধ শতাধিক প্রতিষ্ঠান প্রায় আড়াইশ ধরনের ‘সেক্স ড্রাগ’ প্রস্তুত করে তা অবাধে বাজারজাত করে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌন উত্তেজক সিরাপ, ট্যাবলেট, ক্যাপসুল কিংবা হালুয়ায় অপিয়াম উদ্ভূত অপিয়েট (এক ধরনের মাদক) এবং সিলডেনাফিল সাইট্রেট নামের রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন। সেবনকারীরা সিলডেনাফিল সাইট্রেটে হঠাৎ কয়েক মুহূর্তের জন্য যৌন উত্তেজনা বোধ করলেও এটি স্থায়ীভাবে যৌনক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়। সেবনকারীরা নেশাসক্ত হয়ে পড়ে এবং নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ লিভার, কিডনি ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বনানীর ধর্ষণযজ্ঞসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত যৌন হয়রানিমূলক নানা বর্বরতার পেছনেও ‘যৌন উত্তেজক ওষুধ’ গুরুত্ববহ ভূমিকা রেখেছে। বাড্ডায় মাত্র সাড়ে তিন বছরের শিশুকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যার ঘটনার একমাত্র অভিযুক্ত শিপন। মধ্যবাড্ডার এক হারবাল কোম্পানির ‘কস্তুরি’ ক্যাপসুল সেবন করেই উন্মত্ত হওয়ার দাবি করে সে। অভিযোগ রয়েছে, হারবাল কোম্পানিগুলো চিকিৎসার নামে যৌন উত্তেজক মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট গুঁড়া করে হালুয়া বানিয়ে হারবাল ওষুধ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হারবাল প্রতিষ্ঠানের মালিক ও চিকিৎসকরা রোগীদের আকৃষ্ট করতে নিজেরাই ওষুধের নাম তৈরি করে থাকেন। বাহারি আর ইসলামী কায়দার নাম দেখে রোগীরা আকৃষ্ট হয়। কিন্তু এটি রোধে প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই। অভিযানও চলছে না এসব প্রতিষ্ঠানে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড। কিছু প্রতিষ্ঠান ড্রাগ লাইসেন্সের আড়ালে ভেজাল ওষুধ তৈরি করে বিকিকিনি করছে। এদের অনেকেই অলৌকিকভাবে ঔষধ অধিদফতরের ‘ড্রাগ লাইসেন্স’ পর্যন্ত পেয়ে গেছে। ডাক্তাররা নিজস্ব প্যাডে নয়, বরং চিরকুটে লিখে দেন নানা ধরনের যৌন উত্তেজক ওষুধের নাম। একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রায়হানুল হক জানান, এনার্জি ড্রিংকস নামে যেসব পানীয় বিক্রি হচ্ছে তা হচ্ছে স্রেফ সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পানীয়। এর মধ্যে রয়েছে অ্যালকোহল (মদ) আর সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টির নানা উপাদান। বোতলজাত বা টিনজাত উপাদানের তালিকায় এই অ্যালকোহলের আধুনিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘এনার্জি’। পান করার পর এগুলো শরীরে সাময়িকভাবে ভিন্ন ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করে। যারা নিয়মিত খায় তারা ধীরে ধীরে এতে আসক্ত হয়ে পড়ে। এসব পানীয় নিয়মিত পান করলে কিডনি, লিভার, ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নানা জটিল রোগ সৃষ্টি হতে পারে। এগুলো মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি টেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর এ বি এম ফারুক মনে করেন, যে কোনো ওষুধ নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে বিক্রির অনুমোদন দেওয়া ঠিক নয়। তিনি বলেন, এসব ওষুধ সেবনে শুধু পুরুষত্ব ধ্বংস কিংবা যৌনশক্তি কমে গেল তা নয়, সেবনকারীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকেই। একশ্রেণির হারবাল, ইউনানি নামধারী ভুয়া চিকিৎসক তরুণদের যৌন রোগের ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন উত্তেজক ওষুধ খাওয়াতে থাকেন, যা একসময় ভয়ঙ্কর ক্ষতি ডেকে আনে। অনেকে যৌন অক্ষম পর্যন্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ আবার লিভার ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়।
ঔষধ অধিদফতরের লাইসেন্সের আড়ালে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে প্রস্তুত করছে যৌন স্ট্রং হাই পাওয়ার বড়ি, লং টাইম হালুয়া, হাব্বে কবাদ, স্ট্রং মেসেজ অয়েল মালিশ, সেক্স কিং, বেগম রাহাত, কস্তুরি মালিশ, ব্রেস্ট শক্ত করার মালিশ, কুস্তায় মাড়োয়ারি, কস্তুরি, জিনসেং, প্লাস সেক্সসল, শরবতে জিনসিন প্লাস, নিশাত গোল্ড, রিট্যাব গোল্ড (কুরছ মুকাব্বি খাছ), ট্যাবলেট টাস, ক্রিম টিলা ইত্যাদি নামের যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও সিরাপ। কোনো কোনো হেকিমি দাওয়াখানা ওষুধ সেবনের ৫৯ সেকেন্ডের মধ্যেই ওষুধের গুণাগুণ কার্যকরের গ্যারান্টি পর্যন্ত দেয়। এসব ওষুধ খেয়ে যৌন দুর্বলতা দূর হওয়া পরের কথা, জটিল ও কঠিন রোগে যৌবনশক্তি স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। নারী-পুরুষের যৌন রোগসহ জটিল রোগের চিকিৎসা দেওয়ার নামে বিভিন্ন চক্র দেশজুড়ে প্রতারণার বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে। পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এবং নিজস্ব প্রচারপত্রের মাধ্যমে সেক্স বৃদ্ধি, শুক্রকীট সবল, চিকন ও মোটা স্বাস্থ্য করা, অনিদ্রা, পেট ফাঁপা, একজিমা, গ্যাস্ট্রিক ও চুল ওঠা রোগ শতভাগ নিরাময়ের অঙ্গীকার দেওয়া হয়। এসব প্রচারণায় বিশ্বাস করেই সরলপ্রাণ মানুষ নানা প্রতারণার শিকার হন। জিনসিন পাওয়ার, ম্যাসেজ অয়েল তৈরি করছে প্যানাসিয়া ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ (ইউনানি), বি-জিনসিন, শরবত জিনসিনের উৎপাদক বিসমিল্লাহ ল্যাবরেটরিজ, শামস ফার্মাসিউটিক্যালস প্রস্তুত করে ম্যাক্সিন ফোট যৌন উত্তেজক সিরাপ, বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস ন্যাচারাল আয়রন ও ভিটামিন ক্যাপসুল মেগা গোল্ড, বিডি ইউনানির (চুয়াডাঙ্গা) প্রস্তুতকৃত নিশাত কস্তুরি ট্যাবলেট ও অ্যালো জিনসিন ড্রিংকস নামের যৌন উত্তেজক সিরাপ দেদার বাজারজাত হচ্ছে। একই ধরনের তবে কম-বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন যৌন উত্তেজক ওষুধসমূহ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো হচ্ছে ডিল্যাক্স ল্যাবরেটরিজ (ঢাকা), হেলমো ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি (চাঁদপুর), আধুনিক ফার্মাসিউটিক্যাল (ঢাকা), তোহা ল্যাবরেটরিজ, তোহা ল্যাবরেটরিজ হোমিও ফার্স্ট ফার্মাসিউটিক্যাল (ময়মনসিংহ), নিকো আয়ুর্বেদি (বগুড়া), পিভেনটিজ বাংলাদেশ (বগুড়া), রোজমার্ক ফার্মাসিউটিক্যালস (সিলেট), মল্লিক ল্যাবরেটরিজ (টঙ্গী), সালমা ইউনানি ল্যাবরেটরিজ (ঝিনাইদহ), সুফলা ইউনানি (রাজগঞ্জ, নোয়াখালী), সোলার ফার্মাসিউটিক্যাল (পাবনা), মেসার্স জনি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড (পাবনা), মেসার্স ঢাকা ইউনানি ল্যাবরেটরিজ (ঢাকা), স্নেহা ইউনানি ল্যাবরেটরিজ, আর্ক ইউনানি (চাঁদপুর), সোনালী ল্যাবরেটরিজ এইচ ও এম হারবাল (রাজশাহী), এশিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল ইউনানি, রোজমার ফার্মাসিউটিক্যাল (সিলেট), প্রিভেন্টিজ ইন বাংলাদেশ ইউনানি (রাজশাহী), উয়ুত ল্যাবরেটরিজ ইউনানি (ঢাকা), বেঙ্গল দাওয়াখানা ইউনানি (ফেনী), রিনোভা ফার্মাসিউটিক্যাল (বরিশাল), বেঙ্গল ইউনানি, সরফ ফার্মাসিউটিক্যাল, সেতু ড্রাগ আয়ু (ঝিনাইদহ), আল শেফা ইউনানি ফার্ম (ঢাকা), জেবিএল ড্রাগ ল্যাবরেটরিজ (গাজীপুর), এনা ল্যাবরেটরিজ ইউনানি (সিলেট), এভার গ্রিন ফার্মাসিউটিক্যাল আয়ুর্বেদিক (টাঙ্গাইল), সবুজ ফার্মাসিউটিক্যাল ইউনানি (বগুড়া), সবুজ ফার্মাসিউটিক্যাল আয়ুর্বেদিক (বগুড়া), অরগান হারবাল ল্যাবরেটরিজ (নাটোর), রুহান ফার্মাসিউটিক্যাল ইউনানি (বগুড়া), তালুকদার ল্যাবরেটরিজ আয়ুসহ (বরিশাল) বিভিন্ন ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোম্পানির নামে অনুমোদন ও যথাযথ নিয়ম-কানুন ছাড়া এসব যৌন উত্তেজক ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে।