মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় গলি রাস্তার মাঝখানে ঢাকনা খোলা ম্যানহোল। সকাল হতেই এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেন স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। অথচ এই ম্যানহোল ঢাকনাবিহীন অবস্থায় আছে মাসের পর মাস। আর বৃষ্টি হলেই ম্যানহোল পরিণত হয় মৃত্যুকূপে।
গলির মোড়েই ইদ্রিস আলীর দোকান। তিনি বলেন, এই ম্যানহোলে অসতর্ক অবস্থায় এবং পিছলে পড়ে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। গত সপ্তাহে বৃষ্টির পরে কাদা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একজন আইনজীবী পিছলে পড়ে যান। এসময় তার ডান পায়ের হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে যায় ম্যানহোলে। পরে কয়েকজন মিলে তাকে টেনেহিঁচড়ে উদ্ধার করে। কিন্তু পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না।
রাজধানীতে এভাবে মৃত্যুফাঁদ হয়ে আছে অসংখ্য ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল, খোলা সুয়্যারেজ লাইন এবং গ্যাস, পানির পাইপ বা নির্মাণকাজের সময় খুঁড়ে রাখা গর্ত। ডিএসসিসি ও ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার মোট ৩২ হাজার ৫৯৮টি ম্যানহোল রয়েছে। এর মধ্যে ডিএসসিসির ১৪ হাজার ২৪০টি ও ওয়াসার ১৮ হাজার ৩৫৮টি ম্যানহোল রয়েছে। ডিএসসিসির খাতাপত্রে মাত্র ৩৪টি ও ওয়াসার রেকর্ডে মাত্র ৫৭টি ম্যানহোলের ঢাকনা নেই বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ওই হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। সরেজমিন দেখা গেছে, অন্তত অর্ধেক ম্যানহোলই পড়ে আছে ঢাকনাবিহীন অবস্থায়। ডিসিসি ও ওয়াসা ছাড়াও বাংলাদেশ টেলি কমিউনিকেশন কোম্পানি (বিটিসিএল) ও তিতাস গ্যাস কোম্পানির ম্যানহোল রয়েছে নগরীতে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নানা সংযোগ লাইন নির্মাণকালেও বিভিন্ন স্থানে ম্যানহোল তৈরি হয়েছে। নগরীর ফকিরাপুল, মতিঝিল, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, মালিবাগ, মগবাজার, রামপুরা, বাড্ডা, বাসাবো, মিরপুর, পল্লবী, গোড়ান, তালতলা, শান্তিনগর, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, রাজারবাগ, মুগদাপাড়া, জুরাইন, গোপীবাগ, শহীদবাগ, কদমতলা, সবুজবাগ, লালবাগ, শহীদনগর, ইসলামবাগ, চকবাজার, নয়াবাজার, সূত্রাপুরসহ পুরান ঢাকার সরু অলিগলির অধিকাংশ রাস্তার ম্যানহোলে ঢাকনা নেই। বিভিন্ন জায়গায় বাসিন্দারা নিজ উদ্যোগে লাঠির মাথায় লাল কাপড় লাগিয়ে ম্যানহোলগুলোতে টানিয়ে রাখেন।
শাহজাহানপুরে শিশু জিহাদ আর শ্যামপুরে নীরবের করুণ মৃত্যুতেও টনক নড়েনি ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের। শিশু জিহাদ আর নীরবের মৃত্যুর পর নগরীর ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের তথ্য জানতে চান হাই কোর্ট। তালিকা চূড়ান্ত করতে কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে একটি কমিটিও করে দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু কমিটি কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সে তালিকা চূড়ান্ত হয়নি আজও। নগরবাসীকে ম্যানহোলের তথ্য জানাতে চালু করা হয় হটলাইন ১৬১৬২। এই নাম্বারে ফোন করে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের তথ্য দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তা পুনঃস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু ফোন করে দেখা গেছে নম্বরটি অকেজো।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর রামপুরা ব্রিজ থেকে বাড্ডা লিংক রোড পর্যন্ত সড়কে ৭টি ম্যানহোল উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে। ব্যস্ততম এ সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন শত শত যানবাহন চলাচল করে। বনশ্রী এলাকার বিভিন্ন ব্লকেও একই চিত্র দেখা গেছে। একই অবস্থা মেরাদিয়া হাট থেকে দক্ষিণ বনশ্রী কাজীবাড়ি সড়কে। এ সড়কটির মাঝপথেই রয়েছে কয়েকটি ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল।
বাড্ডা লিংক রোড থেকে গুলশানগামী রাস্তার ডানদিকের গলিতে রয়েছে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল। বাঁশের খুঁটিতে লাল কাপড় বেঁধে সতর্কবার্তা লাগিয়েছেন এলাকাবাসী। তবুও রাতের অন্ধকারে বা অসতর্কতায় খোলা ম্যানহোলে আটকে যাচ্ছে মোটরসাইকেল এবং রিকশার চাকা। ম্যানহোল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নগরবিদ মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ম্যানহোলে লোহার ঢাকনা চুরি হয়ে যাওয়ায় সিমেন্টের ঢাকনা বসানোর বিষয়ে সিটি করপোরেশন কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু কিছুদিন পরে সে উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। আর নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে ঢাকনা তৈরি করায় রাস্তায় গাড়ির চাপে ভেঙে পড়েছে সেগুলো। এজন্য মানসম্মতভাবে রাস্তার সমমানে সিমেন্টের ঢাকনা স্থাপন করলে ম্যানহোলের দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষিত থাকবে নগরবাসী। এসব ব্যাপারে সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজের পরিকল্পনা নিয়েছে সিটি করপোরেশন।
খোলা ম্যানহোল বিষয়ে পদক্ষেপ জানতে ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলীর আতিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি আপনাদের কোনো তথ্য দিব না। কার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন করেন। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাইলে তথ্য দিতে পারি।