বগুড়ায় ভালো কলেজে ভর্তির প্রলোভন দেখিয়ে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত তুফান সরকার এখন সারা দেশের মানুষের কাছে এক আলোচিত নাম। ক্ষমতার মোহে তিনি এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, ধর্ষণের পরও তিনি ক্ষ্যান্ত হননি। নিজের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নির্যাতিতা কিশোরী ও তার মা’কে তুলে মারপিট এবং নির্যাতনের পর দু’জনের মাথা ন্যাড়া করার মতো মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে সামনে নিয়ে এসেছেন তিনি। এ ঘটনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রশ্ন উঠেছে কে এই তুফান সরকার?
জানা গেছে, তুফান সরকার বগুড়া শহরের চকসূত্রাপুরের দরিদ্র মজিবর রহমানের সাত ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তার বর্তমান বয়স ২৪ বছর। মজিবর রহমান একসময় রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। এরপর তিনি চামড়ার দোকানে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। কিছু সময় চামড়ার ফড়িয়া (ক্ষুদ্র) ব্যবসায়ী ছিলেন।
বড় ভাই বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল মতিন সরকারের হাত ধরে তুফানের উত্থান। মতিনের মতো তুফানও এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি , জমিদখলসহ নানা অপকর্মের হোতা হিসেবে পরিচিতি পায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি শ্রমিকলীগের সাথে জড়িত হন। পরে বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক ও কিশোরী ছাত্রী ধর্ষণের হোতা তুফান বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যান। মূলত, শাসক দলের শ্রমিক সংগঠন শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়কের পদকে হাতিয়ার করেই অল্প সময়ের মধ্যেই তার এই উত্থান।
একই সাথে রিকশামালিকের ছবি দিয়ে মালিকের নেমপ্লেপ তৈরি করে তাতে তুফান সরকার স্বাক্ষর দিয়ে অবৈধভাবে প্রায় ১০ হাজার রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা করেন। পুলিশ বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে চাঁদার টাকা ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে শহর ছেয়ে যায় অবৈধ রিকশায়। নেমপ্লেট বাবদ ২০ হাজার টাকা এবং প্রতিদিন ২০ টাকা হারে এ চাঁদা আদায় করে তুফানবাহিনীর কর্মীরা।
তুফানের স্ত্রী আশার বড় বোন মার্জিয়া হাসান রুমকি বিগত পৌরসভা নির্বাচনে পৌরসভার সংরক্ষিত ২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন রুমকিও। তিনি ছোট বেলা থেকেই বদমেজাজি ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তাই তুফানের ধর্ষণের বিচার চাওয়ায় লোহার পাইপ দিয়ে পিটিয়ে জখম করেন কিশোরী ও তার মাকে। এরপর বাসার পাশের সেলুন থেকে জীবন নাপিতকে ডেকে এনে মা ও মেয়ের মাথার চুল কেটে ন্যাড়া করে দেন।
আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন জাতীয় শ্রমিকলীগ বগুড়া শহর শাখার সদ্য বহিস্কৃত আহ্বায়ক ও হঠাৎ কোটিপতি হওয়া তুফান সরকারসহ এ ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।
জানা যায়, গত ২০১২ সালে তুফান সরকারের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়। ২০১৫ সালে তাকে দুই বস্তা ফেনসিডিল ও বিপুল অংকের টাকাসহ গ্রেফতার করেন র্যাব সদস্যরা। পরে ছাড়া পেয়েই তিনি শ্রমিক লীগে যোগ দেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গড়ে তুলেন সুসম্পর্ক।
তুফান সরকার ২০১৫ সালে শহরের চকসুত্রাপুর এলাকায় বাণিজ্যমেলার নামে প্রায় দেড় বছর জুয়া পরিচালনা করেন। অভিযোগ রয়েছে সেখান থেকেই কয়েক কোটি টাকা আয় হয় তার। চোরাই গাড়ি কেনাবেচার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বর্বরোচিত এই ঘটনার মামলায় ঢাকার সাভার থেকে রবিবার রাত ১২টার দিকে তুফানের স্ত্রীসহ ৩ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ হেড কোয়ার্টারস, ঢাকা ও বগুড়া জেলা পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে বগুড়া থেকে প্রাইভেটকারযোগে ঢাকা যাওয়ার পথে তাদের গ্রেফতার করে। একই রাত ৯টার দিকে পাবনা থেকে গ্রেফতার হন তুফান সরকারের স্ত্রীর বড় বোন ও বগুড়া পৌরসভার সংরক্ষিত ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি ও তার শাশুড়ি রুমি বেগম। এছাড়া ওই রাতেই সন্দেহভাজন হিসেবে তুফানের শ্বশুর জামিলুর রহমান রুনু ও ন্যাড়া করে দেয়া নাপিত জীবনকে (২৫) পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
এছাড়া ধর্ষক শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকার ও তার দুই সহযোগী তিন দিনের পুলিশ রিমান্ডে রয়েছে। রুমকিকেও ৪ দিন ও অন্য চারজনকে তিন দিনের রিমান্ড মন্জুর করেছেন আদালত।
বগুড়া পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী জানান, তুফান সরকারের বিরুদ্ধে, হত্যা চেষ্টা, ইয়াবা ও ফেনসিডিল ব্যবসাসহ ৪টি মামলা রয়েছে। সর্বশেষ এ ঘটনায় ধর্ষণ, নির্যাতন অপহরণ ও হত্যা চেষ্টার ঘটনায় আরও দুটি মামলা হয়েছে।