একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে অনেক অভিভাবকহীন যুদ্ধশিশুকে বিদেশিরা দত্তক নিয়ে নিজ সন্তান হিসেবে লালন-পালন করেছেন। সেই বিদেশিদের নিজেদের মা-বাবা হিসেবে জানলেও নিজ জন্মদাতা মা-বাবাকে তথা রক্তের সম্পর্ককে এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছেন বহু যুদ্ধশিশু। উন্নত জীবনযাপন সত্ত্বেও রক্তের বন্ধন তারা ভুলে যেতে পারেননি। যুদ্ধের সময় সঠিকভাবে বাচ্চা দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় সে সময় যেসব বাংলাদেশি শিশুকে বিদেশিরা দত্তক নেন, এদেরই একজন নেদারল্যান্ডসের মুজিবর দে গ্রাফ (৪৩)। তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর পর তার পরিবারের খোঁজ পেয়েছেন। আরেক যুদ্ধশিশু কানা ভারহেউল (৪৪) পেয়েছেন তার বোনের খোঁজ। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি নিশ্চিত করেন এই দুই যুদ্ধশিশু। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফাউন্ডেশন অব অ্যাডপ্টির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, যুদ্ধের পর বাংলাদেশ থেকে যে শিশুদের দত্তক নেওয়া হয় তাদের সঠিকভাবে দত্তক দেওয়া হয়নি। সেখানে উল্লেখ সংখ্যক তথ্যগত বিভ্রাট ছিল। এতে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানকে আর দেখার সুযোগ পাননি। দত্তক নেওয়া এই শিশুরা বিষয়টি বোঝার পর থেকেই নিজেদের মা-বাবাকে খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে এই শিশুদের অনেকের মা-বাবা এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু তারা বাংলাদেশে নিজেদের রক্তের সম্পর্কের যে কাউকে পেলেই খুশি। যুদ্ধ ও পরবর্তীতে বন্যার সময় অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের অনেক শিশুকে সে সময় টঙ্গীর টেরে ডেস হোমস ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ক্যাম্প (বর্তমান গাজীপুর এরশাদ নগর) থেকে নেদারল্যান্ডসে পাঠানো হয়। এই যুদ্ধশিশুদেরই একজন হলেন মুজিবর দে গ্রাফ। তিনি যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে নেদারল্যান্ডসে যে পাঁচশ শিশুকে দত্তক নেওয়া হয় তাদেরই একজন। ১৭ বছর ধরে নিজ পরিবারকে খোঁজার পর অবশেষে গত মাসে বাংলাদেশে এসে নিজ বোন কোহিনূরকে পেয়েছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি জানান, গত মাসে অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমি আমার বোনকে খুঁজে পেয়েছি। আমি অত্যন্ত খুশি যে অবশেষে আমার পরিবারকে পেয়েছি। তবে মুজিবরের বাবা আবদুল আজিজ ও মা মাহমুদা বেগম আর বেঁচে নেই। মুজিবর জানান, নেদারল্যান্ডসের গ্রাফ দম্পতি তাকে দত্তক নেয়। তারা তাকে নিজ ছেলের মতোই বড় করেন। ছোটবেলার কিছু স্মৃতি অস্পষ্টভাবে এখনো মুজিবরের মনে আছে। তিনি বলেন, কাগজে উল্লেখ করা আছে যে আমাকে চার বছর বয়সে নেদারল্যান্ডসে আনা হয়। মনে আছে আমার মা আমাকে অনাথালয়ে দিয়ে যান। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে এখানে রেখে যাচ্ছি। এখানে তুমি ভালো খেতে পারবে এবং লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। ’ একই সঙ্গে তিনি আমাকে আবার দেখতে আসবেন বলেও জানিয়েছিলেন। তবে আমার মনে আছে, মা আমাকে দত্তক দেওয়ার জন্য এখানে রেখে যাননি। মুজিবর বলেন, আমার পুরনো পাসপোর্টে আমার অতীত নিয়ে কিছু তথ্য ছিল তার ওপর ভিত্তি করেই আমি কোহিনূরকে খুঁজে পেয়েছি। মুজিবরের মতো নিজের রক্তের সম্পর্ককে খুঁজে ফিরছিলেন আরেক যুদ্ধশিশু কানা ভারহেউল। অনাথ কানাকেও শিশু অবস্থায় নেদারল্যান্ডসে আনা হয়। বড় হয়ে বাংলাদেশে নিজের পরিবারের সদস্যদের তিনি খুঁজে ফেরেন কানা এবং নিজের পূর্ব জীবন সম্পর্কে অজানা তথ্যগুলো ধীরে ধীরে জানতে পারেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টার পর অবশেষে ঢাকায় গিয়ে আমার বোনকে খুঁজে পেয়েছি। কানা আরও জানান, আমি অনেক দিন ধরে জেনে এসেছি যে, আমার মা বেঁচে নেই। কিন্তু এবার ঢাকায় গিয়ে বোনের সঙ্গে দেখা করে জানতে পারি যে, দুই বছর আগে আমার মার মৃত্যু হয় এবং বাবা ছয় বছর আগে মারা যান। তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাকে দেখতে উদগ্রীব ছিলেন। উল্লেখ্য, টেরে ডেস হোমস নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাটি যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিশুদের খাবার, কাপড় ও লেখাপড়ার সুবিধা দেওয়ার আশ্বাসে তাদের অভিভাবকদের সংস্থাটির স্কুলে ভর্তির জন্য রাজি করান। এই সংস্থাটি তখন আরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশি এই শিশুদের দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থাও করে। তবে নেদারল্যান্ডস, টেরে ডেস হোমস ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে জানতে তারা বিস্তারিত অনুসন্ধান করবে।