নাইমুর রহমান দূর্জয়, বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম অধিনায়ক। মাত্র ২ বছরের আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করা এই ক্রিকেটার ধীরে ধীরে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন দেশের রাজনীতির সঙ্গে। বর্তমানে জাতীয় সংসদের একজন সদস্যও তিনি। এর পরও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন নানাভাবে ক্রিকেটের সঙ্গে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিসিবির অন্যতম এই পরিচালক ৪২ বছর বয়সেও মাস্টার্স ক্রিকেট কার্নিভালে খেলতে চলে এসেছেন কক্সবাজার শেখ কামাল স্টেডিয়ামে। সেখানে বসেই ক্রিকেটের ভালো-মন্দ ও রাজনীতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেন দৈনিক মানবজমিন-এর স্পোর্টস রিপোর্টার ইশতিয়াক পারভেজের সঙ্গে। সেই কথোপকথনের মূল অংশ তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: মাস্টার্স ক্রিকেট কার্নিভালকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দুর্জয়: সাবেক ক্রিকেটারদের জন্য এটি অনেক বড় সুযোগ ফের একসঙ্গে হওয়ার। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক খুশি যে ক্রিকেট ছাড়ার পর আবারও মাঠে খেলতে পারছি। আগের সেই ক্রিকেটাররা, যাদের সঙ্গে সুখ-দুঃখে কেটেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি। তারাও এখানে এসে নিজেদের জমিয়ে রাখা মনের কথাগুলো বলতে পারছে। আমি মনে করি, যারা দেশের ক্রিকেটের জন্য সার্ভিস দিয়েছে তাদের এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে সম্মান করা হচ্ছে। আমি ধন্যবাদ জানাই আয়োজকদের ও স্পন্সরদের এমন সুন্দর সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
প্রশ্ন: ক্রিকেট ও সাগর পাড়ের স্টেডিয়ামকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া কতটা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
দুর্জয়: অবশ্যই এই স্টেডিয়ামটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দ্রুত পাওয়া খুবই প্রয়োজন। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেট ও পর্যটনের উন্নয়নের জন্য সাগর পাড়ের এই স্টেডিয়ামটি করার জন্য গুরুত্ব দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত এই মাঠের কাজ যতটা শেষ হয়েছে তাতে ঘরোয়া ক্রিকেটই আয়োজন সম্ভব হচ্ছে। আশা করি এ বছরের শেষের দিকে নতুনভাবে এই স্টেডিয়ামের কাজ শুরু হবে। আরেকটা বিষয় মাথায় রেখেছি, যেকোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে আমাদের ভেন্যুগুলো নতুনভাবে সংস্কার করতে হয়। তাই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে যে স্টেডিয়ামই হোক না কেন তা যেন আন্তর্জাতিক যে নিয়মগুলো আছে তা মেনেই তৈরি করা হয়। এ স্টেডিয়ামের সঙ্গে শহীদ শেখ কামালের নাম জড়িয়ে আছে, সেটিও আলাদা গুরুত্ব বহন করে। যদি আমরা এখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দ্রুত শুরু করতে পারি তাহলে আমাদের দেশের পর্যটনেরও অনেক বেশি পরিচিতি পাবে। পৃথিবীর দীর্ঘ এই বিচ আরও প্রচার পাবে বিশ্বে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন: দেশে আন্তর্জাতিক মানের অনেক মাঠ থাকা সত্ত্বেও কেন খেলা হয় না?
দুর্জয়: এটি সত্যি যে আমাদের এখানে অনেক স্টেডিয়ামই আছে। কিন্তু দেখতে হবে কিছু বিষয়। যেমন আমাদের ক্রিকেটের মান কিন্তু এখন অনেক বেড়েছে তাই আন্তর্জাতিক হোক আর ঘরোয়া সব কিছুতে একটি মান ধরে রাখতে হয়। মাঠের পাশাপাশি মান ধরে রাখতে হলে ভালো হোটেল প্রয়োজন, এয়ারপোর্ট প্রয়োজন, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হতে হবে। এইসব সুবিধা কিন্তু বগুড়া বা বরিশালে নেই। তবে যেখানে এই সুবিধাগুলো আছে সেখানকার স্টেডিয়ামগুলোকে কাজে লাগাতে হবে বলে আমি মনে করি। আমি বলবো, কক্সবাজার সব সুবিধা থেকে এখন দেশের অন্যতম আকর্ষণ হতে পারে।
প্রশ্ন: সামনেই বিসিবির নির্বাচন আপনার পরিকল্পনা কি?
দুর্জয়: আপনারা জানেন যে কোর্টে একটি রায় এত দিন ঝুলে ছিল। এখন রায় বিসিবির পক্ষে এসেছে। এখন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে। আমারও কিছু পরিকল্পনা তো আছেই। কিন্তু কাল বোর্ড মিটিং (আজ) এর আগে আমি নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইছি না।
প্রশ্ন: টেস্ট দলের প্রথম অধিনায়ক এরপর সংসদ সদস্য, এখন চিন্তায় ক্রীড়া মন্ত্রণালয় নাকি বিসিবি সভাপতি?
দুর্জয়: আমি জীবনে একটি একটি করে অধ্যায় পার করে এসেছি। আমি আমার ভবিষ্যৎ বলতে পারবো না। কিন্তু প্রত্যেকটি মানুষের স্বপ্ন থাকে নিজেকে একটি বড় ধাপে নেয়ার। আমারও তেমন স্বপ্ন আছে- সেটি বিসিবি সভাপতি হোক বা অন্যকিছু। তবে এ-ও বলতে চাই যে, সময়ই বলে দেবে এই আমি কোথায় থাকবো। ক্রিকেট বোর্ডের কথা বললে আমি বলবো সময় হলে আপনারাও দেখতে পারবেন আমি কোথায় থাকি।
প্রশ্ন: প্রায়ই শোনা যায় বিসিবি সভাপতি (নাজমুল হাসান পাপন), প্রধান কোচের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো নয়।
দুর্জয়: সম্পর্ক নিয়ে যেটা বলা হয় বা শোনেন তা ঠিক না । সম্পর্ক তো ভালোই আছে। তবে একসঙ্গে চলতে গেলে, কাজ করতে গেলে মতের অমিল হয়। কারণ, আমাদের কিছু দর্শন বা চিন্তা অন্য কারো সঙ্গে মিলবে না- এটাই সাভাবিক। আবার তাদেরও চিন্তা আমার সঙ্গে মিলবে না। যে কারণে মতবিরোধ বলতে পারেন হয়ই, সম্পর্ক খারাপ কথাটা ঠিক না।
প্রশ্ন: বিদেশি কোচরা যেকোনো খেলা শেষ হলেই ছুটি নিয়ে চলে যান। যে প্রধান কোচ হাথরুসিংহে লম্বা সময়ই বাইরে থাকেন। শুধু সিরিজের আগে তাকে কাজে দেখা যায়, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান হিসেবে এ বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
দুর্জয়: প্রায় সব কোচই সিরিজ শেষ হলে ছুটি পান। এটি সাধারণ নিয়মের মধ্যেই পড়ে। তাদের রিপোর্ট দেয়ার ব্যাপারটাও ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ দেন। তবে আমি একজন সাবেক অধিনায়ক হিসেবে মনে করি বিষয়টা অন্যভাবে। যেমন সিরিজ চলাকালে কোচদের আসলে বড় কোনো স্কিল ডেভেলপমেন্টে কাজ করার থাকে না। তাই সিরিজ ছাড়া কোচদের আলাদা সময় বের করে কাজ করতে হবে।
প্রশ্ন: কোচদের কেউ কেউ ৯০ দিনের বেশি ছুটি কাটান। সেটি নিয়ে কী বলবেন?
দুর্জয়: আমি এখন ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগে নেই। তাই এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা আমার ঠিক না। তার পরও সাবেক অধিনায়ক হিসেবে বলবো সিরিজ ছাড়াও কোচদের কাজ করা উচিত। আমার সময়ও কোচ না বলেই ছুটি নিয়ে চলে গেছেন; জানিও না কার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে গেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, বোর্ডে কাজ করা সবারই জবাবদিহি থাকা উচিত।
প্রশ্ন: ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে এখনো প্রশ্ন, তারপর বিপিএলে ৫ জন বিদেশি খেলিয়ে দেশি ক্রিকেটারদের ক্ষতি করা হচ্ছে কি?
দুর্জয়: অবশ্য এই নিয়মটা কোনোভাবে ঠিক হয়নি। ২০ ওভারের খেলা একাদশে ৫ জন বিদেশি খেললে দেশি ক্রিকেটারদের ফিল্ডিং করা ছাড়া খুব বেশি কিছু করার থাকবে না। আর বিপিএল ঘরোয়া খেলা। এখানে দেশের ক্রিকেটাদের প্রাধান্য দিতে হবে; কারণ এখানে ক্রিকেটার তৈরি হবে। যদি দেশের ক্রিকেটাররা খেলতেই না পারে তাহলে ক্রিকেটার তৈরি হবে কোথায়! এ নিয়মটা মানতে পারছি না। আমি বোর্ড সভায় তা নিয়ে কথা বলবো।
প্রশ্ন: মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকদের বিকল্প পাওয়া কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে কি?
দুর্জয়: এটি কেউ বলতে পারবে না যে সাকিবদের চেয়ে ভালো ক্রিকেটার বা বিকল্প আসবে না। ওদের চেয়ে ভালো ক্রিকেটারও আসতে পারে। তবে তার জন্য আমাদের ক্রিকেটের পাইপলাইন ঠিক রাখতে হবে।
প্রশ্ন: আমাদের শক্তিশালী ‘এ’ দলই নেই তাহলে পাইপলাইন সঠিক থাকবে কী করে?
দুর্জয়: এটি সত্যি যে আমাদের ‘এ’ দলের খেলা কম। তাই ‘এ’ দলকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন এবং তা দ্রুতই করতে হবে।
প্রশ্ন: ক্রিকেট নাকি রাজনীতি, কোনটি বেশি চ্যালেঞ্জের?
দুর্জয়: দুটিই চ্যালেঞ্জের। আবার দুটিই দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ। ক্রিকেট খেলাটা একটু সহজ ছিল। কিন্তু এমপির দায়িত্ব পালন করা অনেক বেশি কঠিন। এখানে নিঃস্বার্থভাবে দেশের মানুষের সেবা করতে হবে। যে কারণে রাজনীতিকে আমি বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে করি।