নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে অব্যাহত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের তদন্তকারীদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ২৮ জুলাই শুক্রবার এই বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে পত্রিকাটি।
সম্পাদকীয়তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সমালোচনা করে বলা হয়েছে, ‘যদি আসাদুজ্জামান খান জাতিসংঘকে সম্মান করেন, তাহলে তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে সংস্থাটির মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান জেইদ রা’আদ আল হুসাইনকে গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য আমন্ত্রণ জানানো উচিত। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ তদন্তের পরই কেবল বাংলাদেশ সরকার সততার সঙ্গে তার জনগণ, বিশ্ব জনমত এবং সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে।’
সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, ‘এই মাসে হিউম্যান রাইটসওয়াচ থেকে গুমের ঘটনাগুলো নিয়ে একটি বিশদ তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বিদ্রূপাত্মক প্রতিক্রিয়া ছিল, “এই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় নেমেছে।” মন্ত্রী সেই সময় প্রশ্ন করেন, “আপনি কাকে গুম বলবেন?” গুমের শিকার হওয়াদের উদ্বিগ্ন প্রিয়জনদের অপমান করে তিনি বলেন, “এখানে পাওনাদারের দাবি না মেটাতে পেরে ব্যবসায়ী নিখোঁজ হয়। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করে কেউ কেউ নিখোঁজ হয়ে যায়”।’
সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, গুমের শিকার হওয়া পরিবারগুলো বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষগুলোর কাছ থেকে নিখোঁজদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তার কোনো সদুত্তর পায় না। আদালত থেকেও তাদের পক্ষে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (হিউম্যান রাইটসওয়াচের) প্রতিবেদন এবং সরকারের দস্যুবৃত্তিসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে ন্যায্য সতর্কতাকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দেন। তিনি এই অসত্য দাবি করেন যে জাতিসংঘ একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেনি।
এই সম্পাদকীয় বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির একটি গোষ্ঠীই রয়েছে, যারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সম্মান নষ্ট করতে এসব তথ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে বিভ্রান্ত করে। এই প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা, তা তারই অংশ। সবাই যে নিখোঁজ হয়নি, সে বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য আছে। বাংলাদেশ সরকার সব সময় সততার সঙ্গে কাজ করে।’
সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অর্থাৎ গত আট বছরে বাংলাদেশে ৩২০ জনের বেশি মানুষ আইনবহির্ভূতভাবে আটক বা গুম হয়েছে। ঢাকার মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর সূত্রে এ তথ্যটি জানা গেছে। নিজ বাড়ি বা সড়ক থেকে সাদাপোশাকে র্যাব বা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যদের তুলে নেওয়া এসব ভিকটিমের মধ্যে বিরোধী দলের সদস্যরা যেমন আছেন, তেমনি আছেন সন্দেহভাজন অপরাধী ও ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা।
অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর গুম হওয়া ৯০ জনের মধ্যে একজন হলেন বিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী মীর আহমেদ বিন কাসেম। গত বছরের আগস্টে কাসেমকে তাঁর বাড়ি থেকে স্ত্রী, বোন ও দুই মেয়ের সামনে দিয়ে কিছু লোক তুলে নিয়ে যান। তাঁরা এ সময় নিজেদের পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এরপর থেকে মীর আহমেদ বিন কাসেমকে আর পাওয়া যায়নি। অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, এই ৯০ জনের ২১ জনকে হত্যা করা হয় এবং ৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
এই প্রবণতায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাড়তে থাকা গুমের ঘটনা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবে গুমের সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকার এ ধরনের অভিযোগের জবাবে অভিযোগকারীদের নিন্দা জানায়, যা আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশি আইনের প্রতি পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সন্ত্রাসবাদ রুখতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা থাকাটা খুব জরুরি।