মিয়ানমারের গুটির চালে বাংলাদেশ তছনছ

Slider সারাবিশ্ব

Bd-pratidin-28-07-17-F-18

‘আর সেভেন’ লেখা বড় গুটি প্রতিটির পাইকারি মূল্য ১৪০ টাকা। ‘ডব্লিউ ওয়াই’ লেখা ছোট গুটির দাম ৫০ টাকা। বিভিন্ন হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত একেকটির দাম পড়ে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা। পাশের দেশ মিয়ানমারের এই গুটির চালে গোটা বাংলাদেশ তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ছোট গুটি আর বড় গুটির ব্যবসায়িক নাম ইয়াবা। মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীরা একে ভালোবেসে সম্বোধন করেন ‘বাবা’ বলে। ছোট গুটি কারও কারও কাছে ‘চম্পা’ নামেও পরিচিত। ভয়ঙ্কর এই মাদক ইয়াবার রং গোলাপি। কিন্তু এই মরণনেশার দংশনে নীল সারা দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতিদিনই এ নেশার জগতে পা বাড়াচ্ছে নতুন নতুন মুখ। হাল ফ্যাশনের সর্বনাশা এ নেশায় জড়িয়ে পড়ছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী, শোবিজের তারকারা। অবৈধ ব্যবসায়ীরা টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার বড় বড় চালান এনে বিভিন্ন কৌশলে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ইয়াবার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সরকার এর চোরাচালান ঠেকাতে গত ২৬ জুলাই থেকে টেকনাফের নাফ নদে সব ধরনের মাছ ধরা ট্রলার চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। কারা অধিদফতরের উপ-মহাপরিদর্শক তৌহিদুল ইসলাম জানান, ‘সারা দেশের ৬৮ কারাগারে যে পরিমাণ বন্দী আছেন এর শতকরা ৪০ শতাংশ মাদক মামলার আসামি। ’ এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দিন দিন এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পুলিশ, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ অন্যান্য বাহিনী সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে ২০১২ সালে ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৭৭৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ লাখ ৩৫ হাজার ৪৫৯ পিসে। ২০১৪ সালে ৩৫ লাখ ৫৫৪ পিস। ২০১৫ সালে ১ কোটি ৩৪ লাখ ২৬ হাজার ২৮৭ পিস। ২০১৬ সালে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৯৬ হাজার ৭৭ পিস। চলতি বছরের মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে জব্দ করা হয় ১ কোটি ৪ লাখ ৫ হাজার ৬২৯ পিস। র‌্যাব সদর দফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত তারা দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে ২ কোটি ৮ লাখ ৬১ হাজার ৫ পিস। একই সময় ফেনসিডিল জব্দ করা হয়েছে ২৯ লাখ ৬৪ হাজার ৪০৪ বোতল। বছরওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে ৯ লাখ ৯২ হাজার ৯৮২ পিস। পরের বছর ৫০ লাখ ১৯ হাজার ৪৫০ পিস। ২০১৬ সালে ৭৭ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮২ পিস। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত জব্দ করা হয় ৫৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৭ পিস। পুলিশ ও র‌্যাবের এ পরিসংখ্যান দেখলেই অনুমান করা যায় সারা দেশে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবমতে, ঢাকায় প্রতিদিন ইয়াবার চাহিদা ২৫ লাখ। এ নেশায় আসক্তদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও রয়েছেন। ইয়াবার মধ্যে যেসব উপাদান রয়েছে এর পুরোটাই মাদক। যারা একসময় ফেনসিডিল ও হেরোইনে আসক্ত ছিল তারা এখন ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। ইয়াবা বহন সহজ ও বেশি লাভজনক হওয়ায় দেশে অন্যান্য মাদকের তুলনায় এটি বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

মেথামফিটামিন ও ক্যাফেইনের সমন্বয়ে তৈরি ইয়াবা ট্যাবলেট দেশে প্রথম জব্দ করা হয় ২০০২ সালের ডিসেম্বরে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন ভূইয়ার নেতৃত্বে একটি দল গুলশান নিকেতনের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে জুয়েল নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে ৩৫০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেফতার করে। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বনশ্রীর অন্য একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেফতার করা হয় তমাল, বাপ্পী ও এমরান হক নামে তিন ব্যক্তিকে। এ অভিযানের পর প্রকাশ পায় দেশে ইয়াবা সেবন শুরু হয়েছে। এর আগে একশ্রেণির তরুণ গাঁজা বা হেরোইনের নেশায়ই বুঁদ থাকত। তাদের কাছে এখন ইয়াবাই বেশি প্রিয়।

ইয়াবা ব্যবসায় শোবিজের তারকারাও : শোবিজের যেসব তারকা ইয়াবা সেবন করতেন তাদের অনেকে এখন ইয়াবা ব্যবসায়ী। ডিজে ও ডিস্কো পার্টির আড়ালেও চলছে ইয়াবা নামক মাদকের জমজমাট ব্যবসা। শুধু তাই নয়, ইয়াবা সেবন ও ব্যবসার পাশাপাশি এদের অনেকে এখন অন্ধকার জগেক বেছে নিয়েছেন। এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে ইয়াবা ব্যবসায়ী মডেল অভিনেত্রীদের তালিকাসহ ক্যাটাগরিভিত্তিক কয়েকটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে।

যৌনক্ষমতা বৃদ্ধির প্রমাণ মেলেনি : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘ইয়াবার মূল উপাদান মিথাইল এমফিটামিন। এর সঙ্গে উচ্চমাত্রায় ক্যাফেইন মেশানো হয়। এ দুটি উপাদান সাময়িকভাবে ক্লান্তি দূর করে। ফলে শরীর ও মনে সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। কিন্তু এটি যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। বরং ইয়াবা দীর্ঘদিন সেবন করলে কেন্দ্রীয় নার্ভ সিস্টেম বিকল হয়ে যায়। ’

ইয়াবা পাচারে যত কৌশল : গ্রেফতার এড়াতে প্রতিনিয়ত কৌশল বদলাচ্ছেন মাদক পাচারকারীরা। এক কৌশল ধরা পড়ে গেলে ব্যবহার করা হচ্ছে আরেক কৌশল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নেওয়া কৌশলগুলো কদিন পরই অভিযানে বা তল্লাশিতে ধরা পড়ছে। সূত্র জানায়, প্রায় দিনই স্থল ও জল সীমান্তসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদক জব্দ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইয়াবাই সবচেয়ে বেশি। আর মাদক পাচারে বাহকদের অদ্ভুত কৌশলে বিস্মিত সংশ্লিষ্টরা। পায়ুপথ, কনডম, মাছ, সবজি, ফ্রিজ, ওভেন, মাথায় নকল চুলের ভাঁজ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন সেট, লাশের কফিন, গাড়ির বিভিন্ন অংশ, অন্তর্বাস, লিপস্টিকের কৌটা, ভ্যানিটি ব্যাগ, গাছের খোড়ল, চানাচুরের প্যাকেট, আসবাবপত্রের জয়েন্ট, এলপি গ্যাস সিলিন্ডার, সুপারি, ক্যামেরা, শুকনো মরিচের ভিতর, বইয়ের ভিতর, বার্মিজ স্যানডেলের তলায়, আমের ভিতরে, গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডারে ভরে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। নতুন কৌশল বিশেষ করে দেহের অভ্যন্তরে ইয়াবার প্যাকেট বহনের কারণে তা অনেক সময়ই প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *