ঢাকা: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনী হিসেবে চান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। তাঁরা ব্যালটে ‘না’ ভোট রাখারও সুপারিশ করেছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১৪টি আইন, বিধিমালা ও নির্দেশনা যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে আইন সংশোধন ও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন। এ কারণে কমিশনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত চাওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা ৯১টি সুপারিশ পাঠান কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখায়। এর মধ্যে একই সুপারিশ অনেকেই করেছেন। তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কর্মকর্তারা মোট ৫৮টি বিষয়ে সুপারিশ করেছেন। গত সপ্তাহে আইন শাখা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় শাখা এবং মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ ও গবেষণা উন্নয়ন শাখার কর্মকর্তাদের পাঠানো এসব সুপারিশকে একটি তালিকায় লিপিবদ্ধ করেছে।
ইসি সূত্র জানায়, এসব প্রস্তাবের একটি খসড়া করে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ নিয়ে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপেও আলোচনা করবে ইসি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ (আরপিও) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় পুলিশ, আর্মড পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে বোঝানো হয়েছে। এতে সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনীর কথা নেই। বর্তমান আইন অনুযায়ী, সশস্ত্র বাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’, তারা ক্যাম্পে অবস্থান করবে, রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রয়োজন মনে করলে তাদের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ডাকবেন।
তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১৯ আগস্ট এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা পালন করে। ২০১৩ সালে আরপিও সংশোধনীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়।
ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সুপারিশে বলা হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়মিত বাহিনীর সংজ্ঞায় আনা দরকার। সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন সরকার বলবৎ থাকা অবস্থায় নির্বাচন হবে বিধায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সব দলের জন্য সমান নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে সশস্ত্র বাহিনীর অন্তর্ভুক্তি গুরুত্বপূর্ণ।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনও মনে করেন, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীকে পুলিশ বা অন্যান্য বাহিনীর মতো করেই মোতায়েন করা উচিত। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে ভোটারদের আস্থা বাড়ে। সেনাবাহিনী মোতায়েন না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন। তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে কেন বাদ দেওয়া হলো, বুঝতে পারলাম না।’
অবশ্য নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের প্রশ্নে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। বিএনপির অন্যতম দাবি ভোটের দিন সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনী হিসেবে মোতায়েন করতে হবে। গত বছরের ২২ নভেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে এই দাবির পাশাপাশি ভোটের দিন সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ারও কথা বলেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রথম দরকার নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ভোটে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের কথা বিএনপি বরাবরই বলে আসছে।
তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনী হিসেবে মোতায়েনের বিপক্ষে। দলটি সশস্ত্র বাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবেই নির্বাচনে দেখতে চায়। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান নির্বাচনী আইন অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী যেভাবে মোতায়েন করা হয়, সেভাবেই আগামী নির্বাচনে রাখা উচিত।
তবে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, আস্থার সংকটের কারণে সেনাবাহিনীর বিষয়টি সামনে এসেছে। তবে এতে যদি দলগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি হয়, তাহলে সেনাবাহিনীকে নিয়মিত বাহিনী হিসেবে মোতায়েন করা যেতে পারে।
ব্যালটে ‘না’ ভোট রাখার বিষয়ে ইসির কর্মকর্তাদের সুপারিশে বলা হয়, একটি আসনের কোনো প্রার্থীকেই ভোটারের পছন্দ না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভোটারের মতপ্রকাশের ভাষা হবে ‘না’ ভোট দেওয়া। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘না’ ভোট ছিল। পরে ২০০৯ সালে বিধানটি বাতিল করা হয়।
তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের কেউই ‘না’ ভোট রাখাকে জরুরি মনে করে না। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এটি দরকার আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। আর বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ বলেন, ‘না’ ভোট রাখা না–রাখা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। এটা নিয়ে কথা হতে পারে।
এ ছাড়া ভয়ভীতির কারণে কোনো প্রার্থী যেন মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধার সম্মুখীন না হন, সে জন্য অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান রাখার সুপারিশ এসেছে। তবে ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণার কারণে উসকানি, ব্যক্তিগত আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তাই অনলাইনে প্রচার চালানো নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘না ভোট’ গণতান্ত্রিক অধিকার। অবশ্যই এটা রাখা উচিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা বন্ধে যে সুপারিশ করেছে, সেটি যৌক্তিক। কেননা, এই মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
বাস্তবতার নিরিখে নির্বাচনী আইনে সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনজন আঞ্চলিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় তাঁদের বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে। ভোট গ্রহণের সময় কর্মকর্তারা আহত হয়েছেন, মারাও গেছেন। প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যেও আতঙ্ক ছিল। আগামী নির্বাচনও দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় হবে। এ কারণে আরপিও বা নির্বাচনী আইনে কিছু সংশোধন-সংযোজন দরকার।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা পরিস্থিতি ভালো বোঝেন। তাঁদের সুপারিশ তাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কমিশনকে সব দিক যাচাই-বাছাই করে আইন সংশোধন ও সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। নির্বাচনে ভোটের পরিবেশে পরিবর্তন আসছে। তাই নির্বাচনী আইনও যুগোপযোগী করতে হবে।
আরও কিছু উল্লেখযোগ্য সুপারিশ
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামায় প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে অনেকেই ‘স্বশিক্ষিত’ লেখেন। কিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। আইনে এটি পরিষ্কার করার সুপারিশ এসেছে। বর্তমান আইনে সরকারি চাকরি থেকে অবসর ও অপসারণের পর তিন বছর অতিবাহিত না হলে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু সরকারের কোনো পদ থেকে পদত্যাগ করলে তাঁর ক্ষেত্রে তিন বছরের বাধ্যবাধকতা থাকবে কি না, সেটা স্পষ্ট নয়। এ কারণে আইনে এই ধারায় ‘পদত্যাগ’ শব্দটিও যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
সুপারিশে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ভোটকেন্দ্র বন্ধে এখতিয়ারের ক্ষেত্রে আরও ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তার পক্ষে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও ভয়ভীতির কারণে অনেক সময় অভিযোগ বা কেন্দ্রের প্রকৃত অবস্থা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানানো সম্ভব হয় না। তাই কোনো কেন্দ্রের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে সন্তোষজনক মনে না হলে, রিটার্নিং কর্মকর্তার সুপারিশের অপেক্ষা না করে রিটার্নিং কর্মকর্তা যেন ভোট গ্রহণ বন্ধ করতে পারেন, সে ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান সহজ করতে বলা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, বর্তমান আইনে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। এতে যে ভোটাররা স্বাক্ষর করেন, তাঁরা ভয়ে থাকেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ব্যক্তিকে কখন বিজয়ী ঘোষণা করা হবে, সেটাও স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে। কর্মকর্তাদের সুপারিশ, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে একমাত্র প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা। এ ছাড়া সমান ভোট হলে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত করার বিধান বাদ দিয়ে সেখানে নতুন করে ভোট গ্রহণের বিধান রাখা এবং আরপিওতে নির্বাচনকালে স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রদবদল, পদোন্নতি নির্বাচন কমিশনের অনুমতি না নিয়ে করা যাবে না, এমন বিধান রাখা।
নির্বাচনের সময় কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দিয়ে মাঠে নির্বাচনী দায়িত্বে পাঠানো, প্রার্থীদের ওপর নির্ভরশীলতার সংজ্ঞায় ‘ভাই-বোনের’ অবস্থান স্পষ্টকরণ, প্রার্থীদের ক্ষেত্রে জামানতের বিধান না রেখে অফেরতযোগ্য ৫০ হাজার টাকা রাখা, প্রতীক বরাদ্দ না হওয়া পর্যন্ত দলীয় প্রার্থীদের প্রচার বন্ধ রাখা, দল ও ব্যক্তির ব্যয় পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচনী এলাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে কমিটি করা, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আয়কর সনদ (টিআইএন) জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, সবার বোঝার জন্য নির্বাচনী আইন আরপিও এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইন বাংলায় করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নির্বাচনী আইন সংশোধনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত কমিটির প্রধান হলেন নির্বাচন কমিশনার বেগম কবিতা খানম। এসব সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি গতকাল বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু আইনি সংস্কারের প্রস্তাব পেয়েছি। এখন সেগুলো দেখা হচ্ছে। কেন, কী ধরনের সংস্কার তাঁরা চাইছেন, তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। প্রস্তাবগুলো একটি খসড়া করে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার পর সংশোধন বা সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’