বঙ্গোপসাগরের এক পাড়ে বাংলাদেশ। আরেক পাড়ে মরণঘাতী নেশা ইয়াবার দেশ মিয়ানমার। সেখান থেকে বড় বড় ট্রলারে মাছের সঙ্গে সাগরপাড়ের জেলা পটুয়াখালীতে আসছে ইয়াবা। মাদকাসক্তরা বলেন ‘বাবা’! তরুণ-যুবক ধ্বংসের ভয়াবহ এই মাদকের আগ্রাসী ছোবল এখন শহরের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রামে গ্রামে। জানা গেছে, গভীর সমুদ্রের মাঝপথ দিয়ে পটুয়াখালী, বরগুনা ও বরিশালে আসছে ইয়াবার বড় বড় চালান। এর মধ্যে মাত্র দু-একটি চালানে আসা ইয়াবা বিক্রি হয় পটুয়াখালীতে। এ ইয়াবায় সবচেয়ে বেশি আসক্ত হচ্ছে তরুণ-যুবকরা। এতে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পটুয়াখালীর আট উপজেলার এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে ইয়াবা পাওয়া যায় না। পটুয়াখালী শহরের আশপাশের ইউনিয়ন লাউকাঠি, লোহালিয়া, কালিকাপুর, বদরপুর, লেবুখালী, জৈনকাঠিতে রয়েছে ইয়াবার বড় বড় ঘাঁটি। এ ছাড়া গলাচিপা, রাঙাবালি, কলাপাড়া, দশমিনা ও মির্জাগঞ্জ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিচিত। পটুয়াখালীতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কার্যালয় বিগত তিন মাসে ১৬৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে জনবল সংকটের কারণে মাদকবিরোধী অভিযানে ঝুঁকি আছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালীতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. এমদাদুল হক মিঠুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পটুয়াখালীর আট উপজেলা ও একটি থানায় অভিযান পরিচালনা করতে মাত্র নয়জনের মতো জনবল রয়েছে। ফলে সাধ্যানুযায়ী অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। আরও কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। অস্ত্রধারী সদস্য ও যানবাহন নেই আমাদের। গ্রামগঞ্জে কোনো অভিযান পরিচালনা করে সফল হলে আসামিদের বহন করতে হয় লোকাল বাসে। সেখানে আমাদের জন্য ঝুঁকি থেকে যায়। ’ পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবের তথ্য-উপাত্তে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব চট্টগ্রাম সমুদ্রে টহল জোরদার করায় মাদক ব্যবসায়ীরা বর্তমানে তাদের রুট পরিবর্তন করেছেন। ফলে তারা ইয়াবার চালান চট্টগ্রামে না এনে বরং টেকনাফ থেকে সরাসরি গভীর সমুদ্রের মাঝ দিয়ে পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল, হাতিয়াসহ উপকূলীয় এলাকায় নিয়ে যান। এসব এলাকা থেকে দেশের সর্বত্র সরবরাহ করা হয় ইয়াবা। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ মাদক ব্যবসায়ী চক্র মাছের ব্যবসার আড়ালে ইয়াবার চালান এনে থাকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পটুয়াখালী কার্যালয়ের তথ্যমতে, বিগত তিন মাসে পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন এলাকায় মোট ১৬৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে তারা। এর মধ্যে ১২টি মামলা করা হয়েছে। এ ১২ মামলার ৪টিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে চার আসামিকে। বাকি ৮টিতে নিয়মিত মামলা রুজু করা হয়েছে। এর মধ্যে ইয়াবার ঘটনাই বেশি। মোট ১১ আসামির মধ্যে সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চারজন পলাতক। বেশির ভাগ অভিযান গ্রাম এলাকায় পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ২০ জুন মহীপুর থানার মাইটভাংগা এলাকায় একটি অভিযান চালিয়ে ১১০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ শাহিনুর বেগমকে (২৮) গ্রেফতার করে মামলা করা হয়েছে। তথ্য রয়েছে, শাহিনুরের স্বামীও বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। লতাচাপলি এলাকার ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম হাওলাদারের মেয়ে শাহিনুর। মহীপুর থানা আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম। জানা গেছে, মিয়ানমারের ওয়া এবং কোকাং নামের আদিবাসী সম্প্রদায় মেথাম্ফিটামিন পিল বা ইয়াবার সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী। এ দুই গোষ্ঠীর লোকজন অতীতে আফিম ও হেরোইন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিল।
ইয়াবা কী : ইয়াবাকে থাইল্যান্ডের ভাষায় বলা হয় ‘পাগলা ওষুধ’। মূলত এটি নেশাজাতীয় ট্যাবলেট। এতে মেথাম্ফিটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণ থাকে। আবার কখনো হেরোইনও মেশানো হয়। এটি উত্তেজক (স্টিমুল্যান্ট) মাদকদ্রব্য। ইয়াবায় উত্তেজক নেশার ভয়ানক মাত্রা থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকর।
ইয়াবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া : ইয়াবা যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট হিসেবে পরিচিত হলেও এটি দীর্ঘদিন সেবনের ফলে যৌনক্ষমতা কমে যায়। যুক্তরাজ্যের ড্রাগ ইনফরমেশন বিভাগের তথ্যমতে, ইয়াবা খেলে সাময়িকভাবে উদ্দীপনা বাড়ে। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হেরোইনের চেয়েও ভয়াবহ। এতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, নিদ্রাহীনতা, খিঁচুনি, ক্ষুধামান্দ্য ও মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিতে পারে। ফুসফুস, বৃক্ক সমস্যা ছাড়াও দ্রুতগতির হৃত্স্পন্দনের মতো সমস্যা হতে পারে। নিয়মিত অভ্যস্ততার পর হঠাৎ ইয়াবার অভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। হতাশা বাড়ে। স্মরণশক্তি কমে যায়। সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে পাগল হয়ে যায়। হতাশাজনিত নানা রকম অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। এমনকি আত্মহত্যাও করতে পারে কেউ কেউ। মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিঁড়েও অনেকে মারা যায়। অনেকে রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়ে। কেউ কেউ টানা ৭ থেকে ১০ দিন জেগে থাকে।