সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে বাংলাদেশে

Slider জাতীয়

75040_f3

 

 

 

 

 

ঢাকা: বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সরকার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে। সন্ত্রাসী সন্দেহে অনেক মানুষকে আটক করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। তবে মাঝে মধ্যেই বিরোধী রাজনীতিক ও স্থানীয় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর উগ্রতা (ভায়োলেন্স) প্রদর্শন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার বার্ষিক সন্ত্রাস বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিষয়ে এসব কথা বলেছে। ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনার ওপর ওই রিপোর্ট প্রণয়ন করেছে ব্যুরো অব কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড কাউন্টারিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘২০১৬ কান্ট্রি রিপোর্টস অন টেরোরিজম’। এতে বাংলাদেশ অংশে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হামলার দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট (একিইআইএস) ও আইসিস। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের উগ্রবাদী আদর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং বাংলাদেশ থেকে তাদের অনুসারী সংগ্রহ করছে। আইসিস ও একিউআইএসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন অনেক প্রকাশনায়, ভিডিওতে ও ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এ রিপোর্টে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রথমেই এসেছে গুলশানে হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার প্রসঙ্গ। এতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ১৮টি সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করেছে আইসিস। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ১লা জুলাই হলি আর্টিজান বেকারির হামলা। এটি একটি রেস্তরাঁ, যা কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত এবং এখানে বেশির ভাগই বিদেশিরা যাতায়াত করতেন। বাংলাদেশি ৫ হামলাকারী সেখানে বন্দুক, বিস্ফোরক ও ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে দু’পুলিশ কর্মকর্তা ও ২০ জিম্মিকে হত্যা করে। জিম্মিদের বেশির ভাগই ছিলেন বিদেশি নাগরিক। এরমধ্যে ৯ জন ইতালির। ৭ জন জাপানের। একজন মার্কিন। একজন ভারতীয় ও দু’জন বাংলাদেশি। যেসব মানুষ পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করে নিজেকে মুসলিম প্রমাণ করতে পেরেছেন হামলাকারীরা তাদের ছেড়ে দিয়েছে। এ ছাড়া বাকি যেসব হামলা হয়েছে তার বেশির ভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অথবা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোপানো হয়েছে।

২০১৬ সালে দুটি হামলার দায় স্বীকার করেছে একিউআইএস। এরমধ্যে ৬ই এপ্রিল হত্যা করা হয় বাংলাদেশি একজন অনলাইন কর্মীকে। আর ২৫শে এপ্রিল হত্যা করা হয় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একজন স্থানীয় কর্মী ও তার বন্ধুকে। দুটি ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা চাপাতি ব্যবহার করেছে। সারা বছর জুড়ে বাংলাদেশে ছোটখাট বেশ কিছু হামলা হয়েছে। তবে এর দায়িত্ব প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে ৭ই জুলাই শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজে হামলা। এতে দু’পুলিশ কর্মকর্তাসহ চারজন নিহত হন। আহত হন সাতজন। আইনপ্রয়োগ, সীমান্ত সুরক্ষা নিয়ে ওই রিপোর্টে বলা হয়, ২০১২ ও ২০১৩ সালে সংশোধিত ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন (এটিএ) পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করছে বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা। যদিও বাংলাদেশের এই আইন সন্ত্রাসীদের নিয়োগ ও তাদের সফরকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, তবু এতে ভাষাগত কিছু বিষয় আছে, যার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন ২১৭৮ (২০১৪) প্রয়োগ করতে পারে বাংলাদেশ। এটা বিদেশি সন্ত্রাসী যোদ্ধাদের হুমকি সম্বলিত বিষয়। বিদেশি সন্ত্রাসী যোদ্ধাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইনের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বিদ্যমান আইনের অধীনে বিদেশি সন্দেহভাজন যোদ্ধাদের অথবা এমন যোদ্ধাদের সহযোগিতা দেয়ার অভিযোগে অনেককে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশ। সীমান্ত, স্থলভাগ, জলভাগ ও বিমানবন্দর দিয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আরো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণে সহযোগী করেছে বাংলাদেশ। সীমান্ত, স্থলভাগ, জলভাত ও বিমানবন্দর দিয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘকেও সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে মনোযোগ দিয়েছে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল বিষয়ক নিরাপত্তায়। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কার্গো শিপমেন্ট ২৮শে জুন বাতিল করে জার্মানি। এর মাধ্যমে তারা বৃটেন ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একই দলভুক্ত হয়। ইন্টারপোলের সঙ্গে আইন প্রয়োগ সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু তাতে নিখুঁত কোনো সন্ত্রাসী ওয়াচলিস্ট দেয়া হয়নি। যাত্রী সংক্রান্ত উন্নতমানের তথ্য ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশে। তাই বাংলাদেশের সীমান্তকে আরো সুরক্ষিত করতে স্ক্রিনিং বিষয়ক অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতামূলক কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নবগঠিত সন্ত্রাসবিরোধী ও বহুজাতিক অপরাধ বিষয়ক ইউনিট (সিটিটিসিইউ) তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে। তারা জাতীয় অনুমোদন পেয়েছে আগস্টে। ১৯-২০ শে ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপ আহসানউল্লাহ বাংলা টিমের সন্দেহভাজন দু’জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এর মাধ্যমে বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কার ও তা ধ্বংস করে দেয়ার পথ তৈরি হয়। হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার পর বহু ঘেরাও দিতে বহু সংখ্যক সন্দেহভাজন জঙ্গিকে হয়তো ধরেছে না হয় হত্যা করেছে আইনপ্রয়োগকারীরা। এর মধ্যে ২৬শে জুলাই ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশ হত্যা করেছে সন্দেহভাজন ৯ জঙ্গিকে। সেখান থেকে পুলিশ আইসিসের পক্ষে বিভিন্ন জিনিসপত্র, বিস্ফোরক ও অন্যান্য অস্ত্র উদ্ধার করেছে বলে বলা হয়। নারায়ণগঞ্জে ২৭শে আগস্ট ঘেরাও অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে আইসিসের বাংলাদেশ প্রধান তামিম চৌধুরীকে হত্যা করে তারা। ১০ই সেপ্টেম্বর আজিমপুরে ও ৮ই অক্টোবর গাজীপুরে উল্লেখ করার মতো ঘেরাও অভিযান চালায় সিটিটিসিইউ ও র‌্যাব। আইসিসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ধরতে এটা পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতামূলক কর্মসূচিতে অব্যাহতভাবে অংশগ্রহণ করছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তারা সন্ত্রাসবিরোধী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের বিচারিক দক্ষতার বিষয়েও প্রশিক্ষণ নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা যোগাযোগ রয়েছে ইউএস স্পেশাল অপারেশন্স কমান্ড প্যাসিফিকের (এসওসিপিএসি)। বাংলাদেশি এমন বাহিনীর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, বাংলাদেশ নেভি স্পেশাল ওয়ারফেয়ার অ্যান্ড ডাইভিং স্যালভেজ (এসডব্লিউএডিএস) ইউনিট, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফার্স্ট প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ও বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ। বাংলাদেশে সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, আর্থিক অ্যাকশন টাস্কফোর্সের মতো আঞ্চলিক একটি সংস্থা এশিয়া/প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি)-এর একটি সদস্য বাংলাদেশ। এগমন্ট গ্রুপ অব ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটস-এরও একটি সদস্য বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আন্তর্জাতিক অর্থ পাচার বিরোধী ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়ন করতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ। এপিজি’র ২০১৬ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এএমএল/সিএফটি মানসম্মত আন্তর্জাতিক মান টেকনিক্যালি বজায় রাখছে বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও দেশে এক্ষেত্রে যেসব প্রবিধান রয়েছে তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রয়োজন। ওই রিপোর্টে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের প্রধান উৎস হলো অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গ্রুপ। তারা ক্ষুদ্র মাত্রায় ক্ষুদ্রঋণ পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। যখনই অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে সন্ত্রাসীদের অর্থায়নের ঝুঁকির মুখে পড়েছে তখনই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে দেশের আইনপ্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। অন্য সব এজেন্সি থেকে তথ্য পাওয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বিএফআইইউকে। এর ফলে তারা উচ্চ মানসম্পন্ন বিশ্লেষণ করে। ভয়াবহ সন্ত্রাস মোকাবিলার বিষয়ে ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সন্ত্রাস মোকাবিলায় তৃণমূল পর্যন্ত পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারের সংগঠনগুলো। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জন সচেতনতা সৃষ্টিতে ইমাম ও ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে কাজ করেছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও এ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এজন্য যোগাযোগ রাখছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা নিচ্ছে পুলিশ। এতে সন্ত্রাসীদের আত্মসমর্পণের বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে বলা হচ্ছে ইমামদের। এছাড়া পুলিশের রয়েছে কমিউটিনি পুলিশি ব্যবস্থা। আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। চিহ্নিত করা হচ্ছে নিখোঁজ ছাত্রদের। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের উগ্রবাদে ঝোঁকার চেষ্টা খর্ব করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *