হৃদয় নিয়ে নানা হৃদয়হীন ব্যবসার ফাঁদ এখন হাসপাতালে হাসপাতালে। হৃদয়ের কবিরাজদের ওপর ভরসা করে ফাঁদ
পেতে বসে আছে নানা চক্র। পেছন থেকে কবিরাজই দিয়ে যাচ্ছেন তাদের রসদ। এতে কেউ প্রাণ পর্যন্ত হারাচ্ছেন, কেউ প্রতারিত হচ্ছেন। কিন্তু কবিরাজদের সবাই কি এমন? না, এদের কেউ কেউ এমন। এমন অনেক হৃদয়ের ডাক্তার আছেন যারা যত্ন করে রোগীদের দেখছেন। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিজের পকেট থেকে অর্থ দিয়ে রোগীদের ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু আরেক শ্রেণীর ডাক্তারের কারণে কত হৃদয় যে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে তার হিসাব ক’জন রাখেন? ব্যাপক অনুসন্ধান আর সরজমিন বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে হৃদয় নিয়ে হৃদয়হীন ব্যবসার অমানবিক সব কাহিনী।
কিন্তু কিভাবে? হার্টে ব্লক ধরা পড়লে অনেক ক্ষেত্রে বসাতে বলা হয় রিং। আর এই রিং নিয়ে বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কোন কোন ডাক্তারের কারসাজিতে কম দামের রিং রোগী কিনতে বাধ্য হচ্ছেন মাত্রাতিরিক্ত দামে। চিকিৎসা নেয়ার পর বছর না ঘুরতেই একই সমস্যা নিয়ে হাজির হচ্ছেন রোগীরা। এমনও রোগী আছেন আগের বছর দু’টি রিং পরেছেন, পরের বছর ফের তাকে করতে হয়েছে ওপেন হার্ট সার্জারি। আবার এমনও দেখা গেছে এক রোগীর অব্যবহৃত পণ্য ব্যবহার করা হচ্ছে অন্য রোগীর দেহে। হাসপাতাল ভেদে একই জিনিসের দামের তারতম্যও রয়েছে বিস্তর। দালালচক্র আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে রোগীদের। এদের সঙ্গে জড়িত হাসপাতালের এক শ্রেণীর কর্মচারী-কর্মকর্তা।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হার্টের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে হার্ট ব্লক হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রোগী যে কোন সময় মারা যেতে পারেন। এমনটি হলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখার একটি পদ্ধতি হচ্ছে স্টেন্টিং বা রিং পরানো। এনজিওগ্রাম করে রক্তনালিতে এক থেকে তিনটি পর্যন্ত ব্লক ধরা পড়লে রিং পরানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। তবে অনেক সময় এনজিওগ্রাম করার পর তাৎক্ষণিকভাবে রিং পরানোর প্রয়োজন না-ও হতে পারে। রিংগুলো দেশের বাইরে থেকেই আসে। এ কারণে রিংয়ের প্রকৃত দাম সাধারণ মানুষের জানার সুযোগ নেই। তাছাড়া, ভালমন্দ বাছবিচার করাও তাদের জন্য অসাধ্য। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ওপরই শতভাগ নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের। চিকিৎসকদের পছন্দের কোম্পানি থেকেই কিনতে হচ্ছে এসব রিং। অনেক চিকিৎসক এনজিওগ্রামের পূর্বশর্ত হিসেবে রিং কিনতে বাধ্য করছেন রোগীদের। বিনিময়ে তিনি ওই কোম্পানি থেকে পাচ্ছেন প্রত্যক্ষ কমিশন অথবা ওই কোম্পানি থেকে বিদেশ ভ্রমণসহ গ্রহণ করছেন বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে এ চক্র খুবই সক্রিয়। রিং বাণিজ্যের কারণে দু’ধরনের প্রতারণার শিকার হন রোগীরা। এক ধরনের প্রতারণা হলো- প্রয়োজন না হলেও চিকিৎসকদের ভয়ভীতির কারণে বাধ্য হন রিং কিনতে। অন্যদিকে কম দামের রিং ক্রয় করেন বেশি দামে। জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেস হসপিটাল) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ১৩টি ইউনিটের অধীনে এনজিওগ্রাম, পেস মেকার ও রিং পরানো হয়। এখানেও কতিপয় চিকিৎসকের নামে আসে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ। এ কারণে রোগীকে রিং পরানোর প্রয়োজন না হলেও তারা পছন্দমতো কোম্পানির কাছ থেকে রিং কেনাতে বাধ্য করেন রোগীকে। এছাড়া নন-মেডিকেটেড (কম দামি) রিংকে তারা মেডিকেটেড (বেশি দামি) বলে চালিয়ে দেন। ফলে বাড়তি টাকা গুনতে হয় রোগীদের। অনেক সময় কমিশন লাভের আশায় অসাধু চিকিৎসকরা প্রয়োজন না হলেও তাদের ভয়ভীতি দেখান- রিং পরানো না হলে রোগী মারা যাবে। এনজিওগ্রামের পর রিং পরানোর প্রয়োজন না হলেও তারা এ ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে থাকেন। এনজিওগ্রাম করতে রিং পরানোকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দেন অনেক চিকিৎসক। অন্যথায় এনজিওগ্রাম করতেও অস্বীকৃতি জানান তারা। এমন ঘটনাও ঘটে যে, কোম্পানির রিংয়ের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় রোগীর ছাড়পত্রও আটক করে রাখেন কেউ কেউ। ফলে ভিটেমাটি বিক্রি করে ওই টাকা যোগাড় করেন তারা। অনেক সময় রোগী কম দামি রিং পরতে চাইলেও চিকিৎসকরা বাধ্য করেন দামি রিং ব্যবহার করতে। যদিও রোগী জানেন না সেটা আদৌ বেশি দামের কিনা। দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি রিং পরানো বাবদ চিকিৎসকরা রিং সাপ্লাই কোম্পানির কাছ থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা কমিশন নেন। এছাড়া, তারা কোম্পানির টাকায় বিদেশ ভ্রমণসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করেন। জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের দু’জন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। রোগীর সঙ্গে তাদের এ ধরনের আচরণ অনেকটা ওপেন সিক্রেট। রোগী রিং পরাতে রাজি না হলে সাধারণত তারা এনজিওগ্রাম করাতে চান না। অতি সমপ্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য তানভীরুল ইসলাম জয়ের রেফারেন্সে হৃদরোগ হাসপাতালে ভর্তি হন মোহাম্মদপুর রায়ের বাজার এলাকার রোগী হতদরিদ্র হোসেন আলী। তিনি ভর্তি হন অধ্যাপক মাহবুব আলীর অধীনে। মাহবুব আলী ওই রোগীর এনজিওগ্রাম করার আগে রিং পরানোর শর্ত দেন। রোগী এবং তার স্বজনরা এনজিওগ্রামের পর অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন জানালে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং তাকে রিলিজ করে দিতে চান। বিষয়টি তানভীরুল ইসলাম জয়ের গোচরে এলে তিনি এনজিওগ্রাম নিশ্চিত করতে অধ্যাপক আফজালুর রহমানের অধীনে স্থানান্তর করেন। পরে ওই রোগীর এনজিওগ্রাম সম্পন্ন হয় এবং হাসপাতাল থেকে একটি বিনামূল্যের রিং তাকে সরবরাহ করা হয়। হোসেন আলীর আত্মীয় শাহ আলম বলেন, ওই ডাক্তারের মাধ্যমে অনেক ভোগান্তির স্বীকার হয়েছিলেন তারা। এছাড়া গতকাল মঙ্গলবারও এক রোগী ও তার স্বজনরা জানিয়েছেন, তিনি এনজিওগ্রাম ছাড়াই ওই রোগীকে রিং পরাতে চান। এ নিয়ে দেন-দরবারও চলছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ ধরনের ঘটনা ওই দুই অধ্যাপকের অধীনে প্রায়ই ঘটে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, একজন প্রফেসর হয়ে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তারা বলেন, চেম্বারে আসেন। সামনা-সামনি কথা বলি। একাধিক রিং আমদানিকারক কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, চিকিৎকদের কমিশনের কারণেই রিংসহ সকল প্রকার সরঞ্জামের দাম বেশি রাখা হয়। তাছাড়া শুধু চিকিৎসকদেরই কমিশন দিতে হয় তা নয়, কর্মচারীদেরও দিতে হয় মোটা অঙ্কের কমিশন। হৃদরোগ হাসপাতালের এনজিও ক্যাথল্যাব বিভাগে কর্মরত ওই টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রতারণার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি রিং বাবদ তাকে ৩ হাজার টাকা দিতে হয় বলেও তারা জানান। এ জন্য কোম্পানি দাম কমাতে চাইলেও তা পারে না। গত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালের ক্যাথল্যাবের সামনে সরজমিন অবস্থান ও পর্যবেক্ষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে। বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানান, ওই ব্যক্তির কাছে কোম্পানি অনেকটা জিম্মি। তাছাড়া, তার পছন্দের কোম্পানির কাছ থেকে রিং কিনতেও তিনি বাধ্য করেন। এছাড়া, এনজিওগ্রাম করার জন্য ব্যবহৃত ওষুধ (ডাই) পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্যও পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। সাধারণত চিকিৎসকরা রোগীকে পরীক্ষা করে চাহিদা অনুযায়ী ডাই কেনার স্লিপ দেন। রোগীকে ক্যাথল্যাবের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে কর্মরত কর্মচারীরা আবারও অতিরিক্ত ডাই ক্রয় করান। পরে সেই ডাই বিভিন্ন ফার্মেসিতে তারা নগদ টাকায় বিক্রি করেন। একজন রোগীর জন্য ১০০ মিলি ডাইয়ের প্রয়োজন হলেও অসাধু কর্মচারীরা ৩০০ মিলি কিনতে বাধ্য করান। উল্লেখ্য, প্রতি ১০০ মিলি ডাইয়ের দাম ২০০০ টাকা। এছাড়া, অনেক সময় একজন রোগীর ব্যবহারের পর অতিরিক্ত থাকা ডাই অন্য রোগীর কাজে লাগায়। এতে ওই রোগীর ঝুঁকি বাড়ে এবং তার কেনা ডাই কর্মচারীরা আত্মসাৎ করে। এ চক্রেরও প্রধান ওই টেকনিশিয়ান। তার বিরুদ্ধে কোন কোন কোম্পানির শেয়ার থাকারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, তিনি প্রায়ই বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন। বিদেশ ভ্রমণের এ সব টাকাও কোম্পানির লোকজন যোগান দেয়। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও ফ্রান্স গেছেন। কোম্পানির লোকজন জানিয়েছেন ওই সব খরচ তারাই বহন করেন। এসব অভিযোগের ব্যাপারে কথা হয় টেকনিশিয়ান তারিকুল ইসলাম লিটনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি এখানে চাকরি করি। কমিশন খাবো কিভাবে? আমার বিরুদ্ধে কথা বললেই সত্য হবে তার কোন মানে নেই। ডাই পাচারের ব্যাপারে তিনি বলেন, মানুষ তো কত কথাই বলবে। এসব অভিযোগের কথা উল্লেখ করলে সরাসরি অস্বীকার না করলেও তিনি বলেন আমি তো বলবো আমি নিই না। এসব কথা শুনতেও আমার খারাপ লাগে। বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, সরকারি কাজে অংশ নিতে বিদেশ গেছি। সরকার ওই খরচ বহন করেছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তিনি নিজ খরচে বিদেশ গেছেন।
হাসপাতাল ভেদে একই মানের রিংয়ের দামেরও বিশাল ব্যবধান বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। বিএমএস (স্টেইনলেস স্টিল) রিং হৃদরোগ হাসপাতালে নেয়া হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। অন্যান্য হাসপাতালে একই রিংয়ের দাম নেয়া হয় আরও ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে। কোবাল্ট ক্রোমিয়াম রিংয়ের দাম হৃদরোগে হাসপাতালে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা, অন্যদিকে রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালে ৬০ হাজার টাকা। হৃদরোগ হাসপাতালে নন-ড্রাগ বায়োডিগ্রেডাবল পলিমার রিংয়ের দাম ৫৫ হাজার টাকা আর অন্যান্য হাসপাতালে রাখা হয় ৬৫ হাজার টাকা। জিয়েন্স প্রাইম-এর দাম হৃদরোগ হাসপাতালে নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। অন্যদিকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ২ লাখ, জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশনে ১ লাখ ৬০ হাজার, ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে ১ লাখ ৮০ হাজার, অনেক হাসপাতালে ২ লাখ টাকারও বেশি আছে। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের একজন প্রাক্তন চিকিৎসক জানান, কিছু অসাধু চিকিৎসক নিম্নমানের রিং সাজেস্ট করে থাকেন। তিনি বলেন অনেক সময় প্যাকেটের গায়ে অনেক কোম্পানির নাম লেখা থাকে। আমদানিকারক কোম্পানি ইচ্ছামতো প্রস্তুতকারী কোম্পানির নামের পাশে টিক দেয়। সেক্ষেত্রে বোঝার উপায় থাকে না সেগুলো ভাল না মন্দ। এমন প্রডাক্টও এমন দেশ থেকে অনেক সময় আসে যেগুলো ওই দেশেই ব্যবহার নিষিদ্ধ।