ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে প্রতি বছর বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার হয় প্রায় ১০ লাখ টাকার। জৈব-অজৈব এসব রাসায়নিকের মধ্যে কিছু পানিতে দ্রবণীয় আর কিছু অদ্রবণীয়। পরীক্ষাগারে ব্যবহারের পর পরিশোধন না করেই এসব রাসায়নিকের একাংশ ফেলে দেয়া হয় মাটিতে। আবার পানিতেও ফেলা হয় কিছু।
রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটেরও। সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম নাইট্রেট, সোডিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড, ইথানল, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ও অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইডের মতো রাসায়নিক নিয়মিত ব্যবহার করছে সংস্থাটি। প্রয়োজন শেষে এসব রাসায়নিক আগুনে পুড়িয়ে ফেলছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সরাসরি কোনো প্রভাব না থাকলেও এভাবে বর্জ্য পোড়ানো পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বেশ ক্ষতিকর বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাসায়নিক বর্জ্যের পরিশোধন ও যথাযথ ব্যবস্থাপনায় এখনো গ্রহণযোগ্য অবস্থানে যেতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সরকারি খাতের শিক্ষা, গবেষণা এবং শিল্পসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেই বর্জ্য নিষ্কাশন ও পরিশোধন ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। যথাযথ নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় এসব বর্জ্য উন্মুক্ত প্রকৃতিতে মিশে যাচ্ছে, বাড়াচ্ছে প্রতিবেশগত ও স্বাস্থ্যঝুঁকি। এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোরও নেই কোনো পরিশোধন ব্যবস্থা। রয়েছে এ নিয়ে যথাযথ আইনের অভাবও। এভাবে পরিশোধন ছাড়াই রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাশন মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর বিভিন্ন অনুজীবের সৃষ্টি করতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে তা পরিবেশের জন্যও বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ পরিশোধন ছাড়াই পরিবেশে নিষ্কাশনের ক্ষতির বিভিন্ন দিক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পরিশোধন ছাড়াই রাসায়নিক বর্জ্য পরিবেশে নিষ্কাশনের ফলে একদিকে যেমন নতুন ক্ষতিকারক অনুজীব সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি এসব রাসায়নিক মানুষের দেহে প্রবেশের পর দীর্ঘমেয়াদে জেনেটিক পরিবর্তনও নিয়ে আসতে পারে। এর ফলে বিকলাঙ্গ মানবশিশুও জন্ম নিতে পারে। এভাবে রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থের নিষ্কাশন হয়তো এখনই আমাদের কোনো ক্ষতি করছে না। তবে দীর্ঘদিনে এসব পদার্থের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া এসব পদার্থ পানিতে মিশে পানির বিওডি ও সিওডির সহনীয় মাত্রা পরিবর্তন করে দিতে পারে। ফলে পানিতে ভাসমান বিভিন্ন জীব এবং এর ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন, ফলিত রসায়ন ও জীববিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অনুষদগুলোয় গবেষণাসহ বিভিন্ন একাডেমিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে নানা ধরনের রাসায়নিক। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায়ও এগুলোর ব্যবহার হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু এসব রাসায়নিক পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই প্রায় কোনো সংস্থারই।
সংস্থার রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান ড. এনামুল হক বলেন, আমরা ধান গবেষণার জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে থাকি। এসব উপাদান বর্তমানে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এভাবে ব্যবস্থাপনায় এখনই তেমন ঝুঁকি নেই, তবে দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ও শরীরের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উন্নত দেশগুলোয় এসব রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় খুবই সামান্য পরিমাণে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে এগুলো ব্যবহারের পর যথাযথ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিষ্কাশন করা উচিত।
ব্যবহূত রাসায়নিক পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই দেশের শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদেরও (বিসিএসআইআর)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. ফারুক আহমেদ বলেন, আমাদের গবেষণা কেন্দ্রের জন্য ব্যবহূত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থেকে সৃষ্ট বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটা ক্ষুদ্রাকৃতির ইটিপি (এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
বিভিন্ন পণ্য ও দ্রব্যের মান ও উপাদান পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রচুর রাসায়নিক ব্যবহার করলেও ব্যবহূত রাসায়নিক পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থাপনা নেই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। সংস্থাটির রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক মো. সাইফুল হাসিব বলেন, আমাদের এখানে রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো ইটিপি নেই। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করি। এগুলো পরীক্ষার সময় সবটুকুই ব্যবহার হয়ে যায়। ফলে এর জন্য বিশেষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো প্রয়োজন নেই।
রাসায়নিক বর্জ্য পরিশোধনের জন্য এখন পর্যন্ত যথাযথ কোনো ব্যবস্থাপনা স্থাপন করতে পারেনি খোদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারি সংস্থাগুলোও। এমনকি এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আইনও প্রণয়ন করা হয়নি। রয়েছে যথাযথ সক্ষমতা ও অবকাঠামোর অভাবও। এ বিষয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এমএ রাজ্জাক বলেন, আমরা শুধু রাজধানীর সলিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনারই কাজ করি। আমাদের রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো সক্ষমতা নেই। তাছাড়া দেশে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আইন থাকলেও রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো আইন করা হয়নি।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের প্রধান নির্বাহী ড. এ আতিক রহমান এ বিষয়ে বলেন, ক্ষুদ্র পরিমাণে হলেও জৈব রাসায়নিক উপাদান যদি পরিশোধন ছাড়াই পরিবেশে নিষ্কাশন হয়, তাহলে পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামক যেমন— উদ্ভিদ, মাছ, পানির মাধ্যমে বিভিন্ন অনুজীব মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে এবং নতুন নতুন ক্ষতিকারক অনুজীবের সৃষ্টি করতে পারে।
শুধু পরিশোধন না করেই বর্জ্য নিষ্কাশন নয়, অব্যবহূত রাসায়নিক উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখারও নজির রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর। আশির দশকে ওয়াটার ক্লিনিং এজেন্ট হিসেবে প্রায় এক টন রাসায়নিক পদার্থ আমদানি করে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। বহু বছর ধরে অব্যবহূত অবস্থায় থাকার পর একপর্যায়ে এগুলো নিয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। অব্যবহূত রাসায়নিক পদার্থগুলো ব্যবহারযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করে কমিটি। অব্যবহূত এসব রাসায়নিক এখনো জাতীয় জাদুঘরের প্রাঙ্গণেই রয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এভাবে যেকোনো রাসায়নিক পদার্থ দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখা বিপজ্জনক। যথাযথ ব্যবস্থার মাধ্যমে এগুলো যত দ্রুত সম্ভব নিষ্কাশনের উদ্যোগ নেয়া উচিত।
অন্যদিকে অব্যবহূত রাসায়নিকগুলো বিপজ্জনক নয় বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণ পরীক্ষাগারের প্রধান ড. গোলাম হায়দার। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থা নেই। অব্যহূত রাসায়নিক পদার্থগুলো বিপজ্জনক নয় বলে এগুলো বাইরে না ফেলে এখানেই রাখা হয়েছে।’